বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ সকালে টংগী শিল্পাঞ্চলে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর সরকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণে ৪ জন নিহত হয় তাছাড়া আহত হয় ১০/১৫ জন শ্রমিক। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো টংগী শিল্পাঞ্চলে, নিরীহ শ্রমিকদের হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ওই দিন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, আর যদি একটি গুলি চলে, যদি এক ফুটো রক্ত ঝরে, আর যদি একটি বাংলার মানুষকে হত্যা করা হয় তাহলে এর দ্বায়দায়িত্ত সরকারকেই বহন করতে হবে।

তার আগে ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে হাজার হাজার জনগণের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, দেশের নাম হবে বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গান, আমার সোনার বাংলা….আমি তোমায় ভালবাসি হবে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় স্লোগান হবে, জয় বাংলা।

গোটা দেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নির্দেশে। চারদিকে শুধু একই আওয়াজ…একই স্লোগান ছিল মুজিব তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে। বাংলার গণমানুষের বন্ধু তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাঘরিষ্ঠ দল বাংলাদেশে আওয়ামীলীগের সংসদীয় দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্তের একমাত্র প্রতীক এবং গোটা দেশের শাষকে পরিণত হয়। ৪ ঠা মার্চ সকাল থেকেই ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে সমবেত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা তাদের প্রাণ প্রিয় নেতা কী সিদ্ধান্ত দেন তা শোনার জন্য। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, পূর্ব বাংলার সচিবালয়, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, স্টেট ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সব অফিস, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশ্ব বিদ্যালয়, শিল্প কারখানা, সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হহে যায়। সারা দেশে চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ও স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলার দ্বাবিতে সর্বাত্তক হরতাল।

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারা বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।

বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধীনতার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থে শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্রছাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।

রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। বেতার-টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ‘বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁরা অংশ নেবেন না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

করাচী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার দাবি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড. এ ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ৬-দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কী না- এ প্রশ্নের জবাবে জনাব ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’

Leave a Reply

%d bloggers like this: