বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চাই : প্রধানমন্ত্রী
কখনও আবেগে অধীর, কখনও বেদনায় বিদীর্ণ, কখনও অঙ্গীকারে দৃপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিলনায়তনে কয়েকশ’ মুগ্ধ শ্রোতা। প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল কণ্ঠে বললেন, যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই বাংলাদেশই গড়তে চাই। তার অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে চাই।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রকাশনা উৎসবে বক্তৃতা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২৫ মিনিটের বক্তৃতার শুরুতেই কণ্ঠে জড়ানো কান্না। পুরো মিলনায়তনে পিনপতন নিস্তব্ধতা। আবেগ সংবরণ করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, দেশের জন্য যে কোনো ভালো কাজ করি বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়। ভালো কিছু করলে মনে হয় আব্বার আত্মা শান্তি পাচ্ছে। যখন কোনো ভালো কাজ করি, তখনই মনে হয় :তিনি থাকলে আরও আগেই এসব ভালো কাজ হতো। মনের মতো করে দেশ গড়ার সময় তিনি পাননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার বছরখানেক পর এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার বড় শক্তি কী?
বঙ্গবন্ধুর জবাব, এ দেশের মানুষকে ভালোবাসি। বড় দুর্বলতা কী? জবাব : এ দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসি।
অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে পুস্তকটি নিয়ে আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। বইটির উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বইটির প্রকাশক বাংলা একাডেমি। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন। শেখ রেহানারও থাকার কথা ছিল। জরুরি প্রয়োজনে হঠাৎ লন্ডন যাওয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একদিন আব্বা-আম্মা পাশাপাশি বসেছিলেন। আমি সে সময় আব্বার খাতা থেকে পড়ছিলাম। আব্বা উঠে এসে কোনো কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এখন পড়িস না, আমার মৃত্যুর পর পড়িস।’ ১৫ আগস্ট সবাইকে হারিয়ে ফেলার পর এ কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা, রাষ্ট্র, আত্মশক্তি দিয়েছেন। যখনই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন, তখন তাকে আর সময় দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তার মৃত্যুর পটভূমি তৈরি করেছিল।
তিনি বলেন, ‘আজকে মায়ের কথা মনে পড়ছে। আব্বা গ্রেফতার হলে তিনি কারাগারে গিয়ে তাকে খাতা দিয়ে আসতেন। পড়ার জন্য বই দিয়ে আসতেন। তিনি সব সময়ই আব্বাকে লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। আম্মা সে খাতাগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের পর দেশে ফিরে ওই খাতাগুলোই খালি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে নিয়ে আসি। আর কিছু নিয়ে আসার মতো ছিল না। সারাবাড়িতে তখনও রক্তের ছোপ লেগে ছিল।’
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের স্মৃতি মনে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কখনও আব্বাকে একটানা দুই বছর কাছে পাইনি। ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে জেলখানাতেই দেখা হতো। আমরা জানতাম, আব্বা দেশের জন্য কাজ করছেন। তাই কোনো আবদার রাখতাম না তার কাছে। কিন্তু যখনই তিনি বাইরে থাকতেন, তখন এতটা আদর দিতেন, সব ভুলে যেতাম। এমন আদর আর কোনো সন্তান তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছে কি-না, জানা নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার আরও লেখা আমাদের হাতে রয়েছে, যা গ্রন্থাকারে বের করার প্রস্তুতি চলছে। তার জন্মশতবর্ষের আগে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে এসবির ৩০ থেকে ৪০ হাজার পৃষ্ঠার গোপন প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে তার জীবন ও বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে। সেইসঙ্গে আগরতলা মামলার দলিলও প্রকাশ করা হবে। এসব লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালোভাবে সবাই জানতে পারবেন। তিনি তার খাতায় যেভাবে লিখেছেন, আমরা সেভাবেই লিখেছি। কোনো সম্পাদনা করা হয়নি।
ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে ভাষায় এ বই লিখেছেন, সেটি নিয়েও গবেষণা হওয়া উচিত। তিনি চলিত ভাষায় লিখেছেন, কিন্তু তার মাঝে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার করেছেন। এতটাই সাবলীল তার লেখা যে, সব মানুষ বুঝতে পারছেন।’ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি_ এ দুই উপলক্ষ সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রামাণ্য জীবনী দেখতে চাই। সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের কার্যক্রমকেও গতিশীল করতে হবে।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দুটি গ্রন্থই এ দেশের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ। বইগুলোর প্রতিটি পাতা পড়তে হবে। একজন রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রস্রষ্টা বঙ্গবন্ধু যে লেখক, তা এ দুই বইয়ে প্রমাণিত হয়েছে। লেখক-পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন, হৃদয়গ্রাহী, বিশ্লেষণধর্মী অনন্যসাধারণ আত্মজৈবনিক রচনা। এ বইয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উঠে এসেছে। সেইসঙ্গে উঠে এসেছে তার রাজনৈতিক তত্ত্বও।’
আলোচক মুনতাসীর মামুন ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, তিন মহীয়সী নারী না হলে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশ হতো না। তারা হলেন_ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিজের দেশকে মা ও কন্যার মতো করে দেখেছেন। তার এ শর্তহীন ভালোবাসা ছিল গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তার গড়ে তোলা সেনাবাহিনী তাকে গুলিবিদ্ধ করায় তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।’ বইটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বইয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর যে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, তার প্রতিটিই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ বইয়ের মতো সুমুদ্রিত ও সুগ্রন্থিত বই এর আগে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেনি। এর জন্য তাদেরও ধন্যবাদ।’
শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এ বইয়ে জেলের আইনকানুন, নিয়মনীতি, অপরাধপ্রবণতা চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। বইটি পাঠ করলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু শুধু বড়মাপের রাজনীতিক ছিলেন না, একজন অসাধারণ লেখকও। তিনি যদি রাজনীতি না করে লেখালেখি করতেন, তাহলে বড় লেখকদের তালিকায় স্থান পেতেন।’
‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থটি এর আগে প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর (২০১২) দ্বিতীয় খণ্ড নয়, এটি বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ নতুন গ্রন্থ। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে লেখা তার দুটি ডায়েরি জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহায়তায় উদ্ধার করা একটি ডায়েরির গ্রন্থরূপ হচ্ছে ‘কারাগারের রোজনামচা’। প্রাঞ্জল ভাষায় বইটির ভূমিকা লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৩২ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য ৪০০ টাকা; ৩০ শতাংশ কমিশনে বইটি পাওয়া যাচ্ছে ২৮০ টাকায়। শিল্পী রাসেল কান্তি দাশ অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি অবলম্বনে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও নকশা করেছেন তারিক সুজাত।