বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবার ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’র স্বীকৃতি পেল ইউনেস্কো থেকে। ভাষণটি সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৩০ অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর কার্যালয়ে এ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন।
জাতির জাগরণে, একটি রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে, দিনের পর দিন সশস্ত্র গেরিলা ও তাদের সমর্থক, সহায়তাকারী, আশ্রয়দাতা নিরস্ত্র মানুষকে উদ্দীপ্ত রাখতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক, দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণের ভূমিকা অবশ্য অনেক আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা ও আলোচনায় স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। বিশ্লেষকরা নিশ্চিত, বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও বিশ্বের অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে এ ভাষণ বিপুল অনুপ্রেরণা জোগাবে।
যেভাবে সিদ্ধান্ত এলো : ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইউনেস্কোর বিশ্ব স্মৃতি বা মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কার্যক্রমের আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির (আইএসি) বৈঠকে। প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে ২৪-২৭ অক্টোবর পর্যন্ত চার দিনের বৈঠকে আইএসি ৭৮টি দলিল বা বিষয়কে দ্য মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারের জন্য মনোনয়ন দেয়। এগুলোর মধ্যে এই ভাষণও রয়েছে।
তবে বিষয়টি এখানেই চূড়ান্ত হয় না। নিয়ম অনুযায়ী, আইএসির সুপারিশে মহাপরিচালকেরও সম্মতি থাকতে হয়। না হলে কোনো দলিল তালিকায় যুক্ত হয় না। মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৭৮টি দলিলের তালিকায় সম্মতি দিয়ে তা ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেন। গত ৩০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে দলিলের এই তালিকা প্রকাশিত হয়।
মনোনয়নগুলোতে সম্মতি দেওয়ার সময় মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা মন্তব্য করেন, ‘আমি গভীর ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ কর্মসূচি দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া উচিত। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তা মনের মধ্যে লালন করতে পারে।’
ইউনেস্কোর আইএসির এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভসের মহাপরিচালক ড. আবদুল্লাহ আলরাইসি। পৃথিবীর বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসা বিভিন্ন প্রস্তাব দুবছর ধরে পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এই তালিকা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তার সাথে ছিলেন বিশ্বের বিখ্যাত আরও ১৪ জন বিশেষজ্ঞ সদস্য।
ইউনেস্কোর এবারের বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের এই তালিকায় আরও রয়েছে ফ্রান্সের ‘আর্কাইভস অব পেরে কাস্টর’, যুক্তরাজ্যের ‘দ্য অরওয়েল পেপার’, ইসরায়েলের ‘ইসরায়েল ফোকলোর আর্কাইভস’, জার্মানির ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট অসউইজ ট্রায়াল’ ও ‘কনস্টিটুসিও আনতোনিনিয়ানা’ ইত্যাদি। ভারতের দুটি বিষয়ও এই তালিকায় রয়েছে।
ইউনেস্কোর এ স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি বলেছেন, বিশ্ববাসী এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।
পরিপ্রেক্ষিত : ৪৬ বছর আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির এক ক্রান্তিকালে স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষের প্রতি ১৯ মিনিটের এই ভাষণ রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে যুক্তিপূর্ণ অথচ আবেগময়, সংক্ষিপ্ত অথচ সুদূরপ্রসারী, ইঙ্গিতপূর্ণ অথচ অর্থবহ বাক্য ব্যবহার করেন, বাংলাদেশের মানুষকে তা আজও উদ্দীপ্ত করে তোলে। এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা, বিশ্নেষণ ও গবেষণায় নিত্যনতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালি জাতি অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের এই ভাষণটি ছিল জনগণের কাছে গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশক। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্ব ইতিহাসের নতুন এক শিখরে পৌঁছে। বিশ্ববাসীও নিশ্চিত হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে হাঁটছে।
‘এ এক অনন্য কীর্তি’ : ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তির ঘটনা বঙ্গবন্ধুর মহান কীর্তির অনন্য স্বীকৃতি। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সারাবিশ্বকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সমানভাবে আলোড়িত করবে। গত ৩১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এমপি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ইংরেজি রূপান্তরও করা হয়েছে। এটি প্রচারও করা হচ্ছে। এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, গত বছরের শুরুতে ইউনেস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি শহীদুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে তথ্য মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে ভাষণটির মনোনয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব ইউনেস্কোতে দাখিল করা হয়।