বঙ্গবন্ধু ও তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ যেন এক মহাকাব্য। বাঙালির প্রাণের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার বাণী। মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইকস ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিলের সংখ্যায় একটি নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং বা রাজনীতির কবি হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই বঙ্গবন্ধুকে এমন সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেছিল আন্তর্জাতিক মহল। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। একটি রাষ্ট্রকে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি ছিল বঙ্গবন্ধুর।
যিনি দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে প্রতিটি বাঙালির মুখে হাসি ফোটাতে বহুবার জেল-জুলুম সহ্য করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব না চেয়ে যে মহান নেতা শুধু বাঙালি জাতির অধিকারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কালোহাত থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। অর্জিত স্বাধীনতা বিজয়-পরবর্তী বাংলাদেশ যখন দৃঢ়পদে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারসহ আমার নানা আবদুর রব সেরনিয়াবাত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি), বড় খালা শেখ আর্জুমনি, ছোটখালা বেবী সেরনিয়াবাতকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেই ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছোট্ট শিশু সুকান্ত বাবু, ছোট মামা আরিফ সেরনিয়াবাত ও শেখ রাসেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আমার মা হামিদা সেরনিয়াবাত সেদিন ঘাতকের ১১টি গুলির আঘাত সহ্য করে ভাগ্যক্রমে কোনো মতে বেঁচে যান। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে আমার মাকে দিল্লিতে নিয়ে চিকিৎসা করালেও একটি পা হারিয়ে তিনি এখনও যন্ত্রণাময় জীবন নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন; যা আমাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। জার্মানিতে থাকার সুবাদে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৭৫-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবায়নকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে সরকার গঠন করে। জ্বালাও-পোড়াও প্রতিহিংসার কর্মকান্ড রুখে দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফল ছিল জনগণের রায়।
দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধী দোসর এবং গণহত্যাকান্ডে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সব যুদ্ধাপরাধীকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে বিচার করে দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের উজ্জ্বলতম সাফল্য, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়ায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে অনুসরণ করে রুয়ান্ডার সরকার সে দেশের গণহত্যায় জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে জীবন্ত দৃষ্টান্তের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন। তারই সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানে ইউরোপের মতো দেশগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত, সেখানে শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ও সুদক্ষ কৌশলে এদেশের ওপরে অর্থনৈতিক মন্দার কোনো প্রভাব পড়েনি, যার ফলে এদেশের মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়নি এবং চ্যালেঞ্জের সঙ্গে ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের দ্বিগুণ বেতনের পে-স্কেল ঘোষণা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিডিপি ৭.১১ এবং ১ হাজার ৪৬৫ ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২০১৭ সালে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ ধরা হয়েছে। যানজট নিরসনে রাজধানীতে মেট্রো রেল প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং বিভিন্ন স্থানে উড়াল সেতু ও হাতিরঝিল প্রকল্প সমাপ্ত করে নান্দনিক শহরে রূপান্তর করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে মিয়ানমার ও ভারতের আওতায় থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক বিজয়। ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি এবং মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাংলাদেশের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার করা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতির বই বিনামূল্যে বিতরণ করে শিক্ষার হার ৪৪ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ প্রণয়ন করা হয় এবং নারী জনশক্তিনির্ভর তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয়। একটি বাড়ি একটি খামার, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধায় নিম্ন আয়ের পরিবারের সংখ্যা ১৫ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, এদেশের মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। তার এ ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যি হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের সঠিক প্রচেষ্টা, কর্মদক্ষতা ও সুদৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
কিন্তু বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু যাদের ঘর ঠিক করে দিয়েছিলেন আজ তারাই তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে হিংসার ফানুস উড়াচ্ছেন। সেটা ক্ষণস্থায়ী মাত্র। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার প্রতিটা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা গভীর ষড়যন্ত্র করে আসছে।
এমনকি কতিপয় গরিবের রক্তচোষা লেবাসধারী দালাল যারা দেশীয় ও বিদেশি চক্রান্তকারীর দোসর। যারা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে বিমুখ করে বহুল কাক্সিক্ষত প্রকল্পটির বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এটা ছিল জনগণের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
বঙ্গবন্ধু যেমন পরাশক্তির কাছে মাথানত করেননি, ঠিক তেমনি যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অশুভ শক্তির কাছে মাথানত না করে বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের অর্থায়নে বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন, যার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়ায় বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন।
২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড করতে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও শেখ হাসিনার সুযোগ্য সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে আইসিটি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষিত যুবসমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দূর করে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করে দেশের প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে বর্তমান সরকার এক নজিরবিহীন দৃষ্টি স্থাপন করেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর লক্ষ্যে সৌর বিদ্যুৎ, কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ ১৫ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট উৎপাদন করে ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ভূ-উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর উৎক্ষেপণ হবে। টেন্ডারবাজি বন্ধে ই-টেন্ডার, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মোবাইল ফোন ও কলরেট এবং ইন্টারনেট দাম কমিয়ে ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, ৯টি নতুন বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন দেয়ায় জনগণ ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। সার্বিক তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গত বিশ্বকাপে ফাইনালে চ্যালেঞ্জিং খেলায় ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শততম টেস্ট খেলা ঐতিহাসিক বিজয় ছিনিয়ে আনে। প্রতি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
সাবমেরিন ক্রয়সহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়েছে। ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসার সঙ্গে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’, ‘সাউথ-সাউথ’ এবং ‘আইসিটি’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে একজন মানুষকে মারল সে যেন গোটা মানব জাতিকে মারল।’ কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের মদদ দিয়ে দেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ধর্মবিরোধী এ গোষ্ঠী দেশে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে বেহেশতে যাওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষের মগজ ধোলাই করে জঙ্গিবাদের ভয়ানক পথে টানছে। তারা বিশ্বে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে তৎপর। কিন্তু শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ তারা ব্যর্থ হবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধির বাংলাদেশ কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উগ্রজঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার তার ঐতিহ্য ধারাকে অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ তথা শক্তিশালী, সুখী-সমৃদ্ধির সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে। অচিরেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়াবে।