বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম

বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা

১৭ মার্চ পালিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। এবার ছিল ৯৭তম জন্মবার্ষিকী। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের শেখ লুৎফুর রহমান ও সায়রা বেগম এর ঘরে ১৯২০ সালে তাঁর জন্ম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন ৩য়। খোদায়ী প্রদত্ত নেতৃত্বের যে গুণাবলী তাঁর ছাত্রজীবন হতে দেখা গিয়াছিল তা বাংলাদেশ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রমাণিত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী গৃহশিক্ষক হামিদ মাস্টারের প্রভাবে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি।

১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কোলকাতার গড়ের মাঠের জনসভায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্র মিছিল গিয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যিনি, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর জেলার নির্বাচন সংঘটনের মূল দায়িত্ব দিয়াছিলেন। ১৯৪২ সালে কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আই এ (উচ্চ মাধ্যমিক) পড়ার সময় শেখ মুজিব ছাত্র এবং বৃহত্তর রাজনীতিতে জড়িত হন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী’র ভাবধারায় তাঁর রাজনীতির দীক্ষা।
১৯৩৭ সালে গঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, ১৯৩৮ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ মুজিব ১৯৪০ সালে সে সংগঠনে যোগ দেন। দুই শিবিরে বিভক্ত মুসলিম লীগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম প্রগতিপন্থী এবং আক্রাম খাঁ ও খাজা নাজিম উদ্দিন ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল পন্থী। শেখ মুজিব প্রগতিপন্থীতেই ছিলেন । তিনি ১৯৬৬ সালে লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় ১০ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপন করেন। বন্দী শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রায়ই বলতেন “একদিন শেখ মুজিব ইতিহাস সৃষ্টি করবে।” (সূত্র:- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি প্রথম খন্ড)। ছাত্রজীবন হতে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বহুবার জেল খাটা ছাড়াও ফাঁসি কাষ্ঠের কাছাকাছি গিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারী মধ্যরাতে উনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বেকসুর খালাসের লিখিত আদেশ দিলে, তিনি নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন করলেন “আমাকে খালাস দেওয়া হল কি নতুন ফাঁদে নেওয়ার জন্য?”
তিনি নিজের মনে বলে উঠলেন “বুঝলাম সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।” বিদায়ের পূর্বে সঙ্গী বন্দী আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন Ñ“বন্ধু বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানিনা কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে। হয়তঃ বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাবার সময় আপনাকে শুধু একটা কথা বলে গেলামÑ বাংলাদেশের সাথে কোনদিন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনদিন করব না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।” শেখ মুজিবের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। (সূত্র:- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি-প্রথম খন্ড)। পরে জানা যায়, তাঁকেসহ ৩৫ জনকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে বিচারের জন্য কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাখা হয় এবং উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ না রেখে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কিন্তু ’৬৯এর গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদ, নবকুমার ইন্সটিটিউটের মতিয়ুব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহাসহ বাংলার অনেককে হত্যার পর ২২ ফেব্রুয়ারী, আয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
শেখ মুজিবসহ সকল বন্দীকে মুক্তি দেন। ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন ও ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ২৫ মার্চ ১৯৬৯ জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ মহিলা আসনসহ ৩১৩ টির মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে। কিন্তু ইয়াহিয়া, ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত্রে সেনাবাহিনী নামিয়ে গণহত্যা শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না বুঝতে পেরে জনগণকে প্রস্তুতির সময় দিতে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বঙ্গবন্ধু শুধু বলেছিলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। “তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক।”ঐ দিন যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে সামরিক জান্তা উপস্থিত লক্ষ লক্ষ লোককে মেরে ফেলত। বঙ্গবন্ধুও হয়ত মারা যেতেন। বাঙালীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারত না। আর, বাংলাদেশও স্বাধীন হত না। এতেই তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
২৫শে মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানী সেনারা গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরেই তৎকালীন ই পি আর এর বেতারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলত তারা আজ সমীহ করে কথা বলে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, খেলাধুলা সব কিছুতে উন্নত এদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখে যেতে পারলে না। অকৃতজ্ঞ, স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী স্বাধীনতার যুদ্ধের পরাজিত মৌলবাদী পাকিস্তানী মতাদর্শের অনুসারী কিছুলোকের হাতে শাহাদাত বরণ করলেও নির্বংশ করতে পারে নাই। আল্লার অশেষ রহমতে শেখ হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তৈরীতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশকে পৃথিবীর একটি সম্মানী রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধুর উচ্চ শিক্ষিত নাতি, নাতনীরা যোগ্য মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবে নিজেদের যোগ্যতায় আজ আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধা ভোগীদের বংশধররা লেখাপড়ার রাষ্ট্রীয় সুযোগ নিয়েও তেমন করতে না পারলেও, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কেউ পরপারে আর কেউ সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে স্বপরিবারে স্বনির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।
এজন্যই বলে, “ভাল বীজে ভাল ফসল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *