বঙ্গবন্ধু কি জানতেন?
বঙ্গবন্ধুকে আগে থেকেই ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, তার জীবনের ওপর হামলা আসতে পারে। ওই সময়ের নানা দলিলপত্র আর প্রতিবেদন বলছে সে কথাই।
একটা প্রশ্ন ১৯৭৫ সালেও যেমন ভেসে বেড়াত বাতাসে, এখনো তেমনি ভেসে বেড়ায়—বঙ্গবন্ধু কি জানতেন, তাঁর জীবনের ওপর আঘাত আসতে পারে? যদি জানতেনই, কেন তিনি সতর্ক হলেন না? দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও কেন তিনি থাকতেন প্রায় অরক্ষিত ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডের নিজ বাসভবনে?
আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে সহানুভূতিশীল মানুষ তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিদেশি কোনো কোনো রাষ্ট্রও তাঁকে তাঁর জীবন সংশয়ের বিষয়টি জানিয়েছিল। কিন্তু তিনি তেমন গুরুত্বই দেননি। কেন দেননি? তিনি কি ভাবতেই পারেননি, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে? দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল এতটাই প্রগাঢ় বিশ্বাস।
মনে পড়ে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর কোনো এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।
সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন: আর সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা?
বঙ্গবন্ধুর উত্তর, আমি আমার দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।
দেশের মানুষের প্রতি এই বিশ্বাস, এই ভালোবাসাই কি বঙ্গবন্ধুকে ভয়ঙ্কর কিছু ভাবতে দেয়নি?
এখন ধীরে ধীরে জানা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর আঘাত আসতে পারে, সে খবরটি তাঁর কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি তা তিনি একেবারেই গুরুত্ব দেননি।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমেদ। ক্রিটিক্যাল টাইমস, মেমোয়ার্স অব এ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট নামের বইটির ১৪০ পাতায় তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দু সপ্তাহ আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন। সুইডেনের পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা কিছু ক্লিপিংসসহ আমি তাঁর কাছে গেলাম। এর মধ্যে একটি প্রতিবেদন ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসন্তোষ এবং কিছু সংখ্যক সেনা কর্মকর্তার সামরিক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির বিষয়ে। তিনি এই প্রতিবেদনকে গুরুত্বই দিলেন না এবং বললেন, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ব্যাপারটি দেখতে বলবেন।’ (ইংরেজি থেকে অনুবাদ)।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা দলিল থেকে আঁচ পাওয়া যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। হেনরি কিসিঞ্জার এবং মার্কিন সরকারের নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড আথারটনের মধ্যে কথোপকথন থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টি জানালেও মুজিব তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। দলিল থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় সকাল আটটা (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা)। মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১১ ঘন্টা পর। হেনরি কিসিঞ্জারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেছেন। আলফ্রেড আথারটন বলেন, এটা হচ্ছে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত একটি অভ্যূত্থান। এরপরই আচানক কিসিঞ্জার প্রশ্ন রাখেন, গত বছর আমরা কি তাঁকে (শেখ মুজিব) বলিনি?
আথারটন: মার্চে আমরা বেশ আলামত টের পেয়েছিলাম।
কিসিঞ্জার: আমরা কি তাঁকে সেটা জানাইনি?
কে বা কারা এটা করতে পারে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা কি আমরা তাঁকে দিইনি?
আথারটন: আমরা তাঁকে নামধাম বলেছিলাম কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
এ সময় সিআইএ-র সাবেক কর্মকর্তা হিল্যান্ড বলেন: এ বিষয়ে তাঁর কাছে আমরা কিছুটা অষ্পষ্ট ছিলাম।
আথারটন: তিনি (মুজিব) তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বলেন, তার সঙ্গে এমন কিছু কেউ করতে পারবে না।
১৯৮৯ সালের ২৩-২৯ এপ্রিল সংখ্যার কোলকাতার সানডে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিক্রিয়াধর্মী লেখার প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (RAW)-এর প্রধান ছিলেন আর এন কাও। তিনিই লিখেছিলেন প্রতিক্রিয়াটি। ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে যে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়, তারই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন কাও। সে লেখাটি থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আগাম তথ্য পেয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তারা জানত, সেনাবাহিনীর কিছু অসন্তুষ্ট সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। আর এন কাও নিজেই ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এই তথ্য জানিয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতিক্রমে কাও ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। সে যাত্রায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে কাও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গভবনের বাগানে একান্তে পায়চারি করতে। সেখানে গিয়ে কাও বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয় রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না।’ কাও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে শুধু বলেছিলেন, আমরা খুব বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি। তিনি চাইলে এই ষড়যন্ত্রের বিশদ তথ্য তাঁর কাছে পাঠানো যেতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তথ্যগুলোর বিষয়ে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী সেনা ইউনিট দুটি। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু এই সতর্কবাণীকেও অগ্রাহ্য করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর বুকের ভেতর স্পন্দিত হতো মহান এক হূদয়। ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে তাঁর বিশালতা। এ কথা এখন বলাই যায়, বঙ্গবন্ধুকে নানা দিক থেকেই সম্ভাব্য সেনা বিদ্রোহ বা অভ্যূত্থানের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাসই করতে চাননি। বিশাল হূদয়ের এই মানুষটি বিশ্বাসই করতে পারেননি, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে, এটাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্য। (সংকলিত)
জাহীদ রেজা নূর:
লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক