বঙ্গবন্ধু : ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ
দিনটি ১৯ জুন ১৯৬৮ সাল। আগরতলা মামলার প্রথম দিন। এক নম্বর আসামি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ আদালতে উপস্থিত হয়েছেন। লক্ষ করলেন তার সামনে তার দিকে পিঠ দিয়ে অনেক সাংবাদিক বসে আছেন। একেবারে তার সামনে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। বঙ্গবন্ধু তাকে নাম ধরে ডাকলেন।
সৈয়দ বদরুল আহসান: ‘বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কথা বলতে হবে।’ কথাগুলো বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হন নি। তখনও জাতির পিতা হন নি। তখনও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
দিনটি ১৯ জুন ১৯৬৮ সাল। আগরতলা মামলার প্রথম দিন। এক নম্বর আসামি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ আদালতে উপস্থিত হয়েছেন। লক্ষ করলেন তার সামনে তার দিকে পিঠ দিয়ে অনেক সাংবাদিক বসে আছেন। একেবারে তার সামনে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। বঙ্গবন্ধু তাকে নাম ধরে ডাকলেন। কোনো উত্তর নেই। আবার ডাকলেন। কোনো উত্তর নেই। তৃতীয়বার একটু উচ্চৈঃস্বরে ডাকলেনÑ ‘এই ফয়েজ।’ ফয়েজ আহমদ হাল্কা ও স্বল্প জবাব দিলেনÑ ‘এখানে কথা বলা যাবে না, মুজিব ভাই। গোয়েন্দারা আছে।’
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর উপরের সেই সাহসী উক্তি। এই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছিল না তার কোনো ভয়। ছিল অগাধ আত্মবিশ্বাস। সেই আগরতলা মামলা চলাকালে এক বিদেশি সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলেনÑ ‘আপনার কি মনে হয়Ñ আপনার ভবিষ্যৎ কী?’ একটু মুচকি হেসে বঙ্গবন্ধু বললেনÑ ‘ণড়ঁ ষরংঃবহং ঃযবু পধহহ’ঃ শববঢ় সব যবৎব সব সড়ৎব ঃযধহ ংরী সড়হঃয’ং Ñ ওরা এখানে আমাকে ছয় মাসের বেশি রাখতে পারবে না।’ এক মাস বেশি লেগেছিল। সপ্তম মাসে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছিলেন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এ।
ব্যক্তি মুজিবের ছিল অদম্য সাহসÑ সীমাহীন আত্মবিশ্বাস। গোটা যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। বন্দী অবস্থায় দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেনÑ ১৯৬৮ ও ১৯৭১-এ। ভয় তার মনে প্রবেশ করেনি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম চলছে আর তিনি সুদূর মিয়াওয়ালী কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেনÑ কোনো পত্রিকা নেই পড়বার, রেডিও নেই শুনবার। তবুও সাহস হারান নি।
এই ছিল আমাদের শেখ মুজিবুর রহমানÑ আমাদের শেখ সাহেবÑ আমাদের বঙ্গবন্ধু।
তিনি মানুষের নাম ভুলতেন না। ২০ বা ৩০ বছর পার হয়ে গেছে কোনো বন্ধু অথবা ব্যক্তির সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর। তবুও তার স্মৃতিশক্তি রয়েছে প্রকট। প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তীর সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল অনেক দিনেরÑ সেই ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। সেই বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সেই যোগাযোগ আর থাকেনি। ২৫ বছর পর ১৯৭২ সালে, নিখিল চক্রবর্তী এসেছেন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায়। বঙ্গভবনের দরবার হলে একবারে পেছনের সারিতে তিনি বসলেন। তার মনে একটি কথাÑ আমার এই পুরনো বন্ধু আমাকে চিনবে নাÑ চিনবার কারণও নেই।
বঙ্গবন্ধু দরবার হলে প্রবেশ করলেনÑ চারদিকে তাকালেন। একসময় তার দৃষ্টি সেই ভারতীয় সাংবাদিকের দিকে নিক্ষেপ করলেন।
‘তুই নিখিল না?’Ñ নিখিল চক্রবর্তী অভিভূত। এত বছর পর আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? তার প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘আপনি কি রে? তুই গেল কোথায়?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর। বঙ্গবন্ধু নিখিল চক্রবর্তীকে জড়িয়ে ধরলেন।
এই ছিলেন ব্যক্তি মুজিব। কোনো অহঙ্কার নেইÑ মানুষের থেকে কোনো দূরত্ব নেই। মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। সেই লক্ষে তার গোটা রাজনৈতিক জীবন কেটেছে গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে পায়ে হেঁটেÑ কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক সবার সঙ্গে কথা বলে। কথা বলতে তিনি ভালোবাসতেনÑ অন্যের কথা শুনতে ভালোবাসতেন।
মানুষটি ছিলেন উদারমনাÑ অসাম্প্রদায়িক। যে মুজিব তার রাজনৈতিক জীবন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেই মুজিব রূপান্তরিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুতেÑ স্বাধীন বাংলার স্থপতিতেÑ সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বে।
তার রাজনীতি সেই ইতিহাসটিই তুলে ধরে। তিনি সেই ৬-দফার মধ্য দিয়ে কেবল বাংলাদেশের স্বাধিকার ও পরবর্তীতে স্বাধীনতাই চান নিÑ চেয়েছিলেন গোটা পাকিস্তানকে নতুন অসাম্প্রদায়িক ফেডারেল (ঋবফবৎধষ) আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে। ৬-দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ৬-দফার লক্ষ্য ছিল ঐ এক-দফাÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই সত্যটি আরও বেশি করে আমরা অনুধাবন করি যখন তিনি সেই মার্চ ১৯৭১-এর আলোচনার শেষ ভাগে পাকিস্তানি শাসকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি ঈড়হভবফবৎধঃরড়হ-এ পরিণত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস বরাবরই ছিল সাংবিধানিক এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে। ৬-দফা তারই প্রমাণ। মার্চ ১৯৭১-এ যে আলোচনা তিনি তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে চালিয়ে যান সেখানে তার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সব সময় অবাধ নির্বাচনের কথা বলেছেনÑ জনগণের আস্থাকে তার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
আপস তিনি কখনও করেন নি। সবার সঙ্গে কথা বলেছেন, সবার মতামত নিয়েছেন এবং সেই মতামতের ভালো দিক তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির একটি বড় উদাহরণ তার ৭ই মার্চের ভাষণ। সেই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা করেন নিÑ তবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। তিনি টউও (টহরষবঃবৎফ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব)-এর দিকে পা বাড়ান নি। তার সামনে রোডেশিয়ার ইয়ান স্মিথ-এর ১৯৬৫ সালের উদাহরণ ছিল। ছিল বায়াফ্রার অজুবওযুর ১৯৬৭-এর কাহিনি। দুজনের একজনও সফল হননি।
আর বঙ্গবন্ধু তো ছিলেন নির্বাচিত নেতাÑ সংখ্যাগুরু দলের নেতা। তিনি তো আর হঠকারী রাজনীতি কখনও করেন নি। তিনি কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হবেন? এই মূল্যবোধগুলো তার রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বরাবরই কাজ করেছে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস ছিল বঙ্গবন্ধুর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস। নিয়মতান্ত্রিক পথে পাকিস্তান যায় নিÑ তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা দেখ দিল।