বদলে গেছে শহর-গাঁও উন্নয়নের সোনার নাও

বদলে গেছে গ্রামীণ বাজারের চেহারাও। প্রত্যন্তাঞ্চলের মুদি দোকানেও বিক্রি হচ্ছে শ্যাম্পু, সুগন্ধি সাবানসহ প্রসাধন সামগ্রী। গ্রামের মানুষ এখন আগাছা অথবা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে না, টুথপেস্ট-ব্রাশ না হলেও অন্তত টুথ পাউডার ব্যবহার করে।

51জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন হলো দেশের সকল মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-দর্শন থেকে উৎসারিত এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি দ্বারা অঙ্কুরিত হয়েছে। বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। কাজেই একটি উন্নত সমৃদ্ধ জাতি-রাষ্ট্র গঠনে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন অপরিহার্য। নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সকল মানুষের উন্নয়নÑ তথা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নে গৃহীত খসড়া ম্যানিফেস্টোর শুরুতেই বলা হয়েছেÑ ‘সামাজিক অবস্থা মতামত ও নারী-পুরুষ নির্ব্বশেষে পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণের ধর্ম্ম সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু জীবনের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।’ জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ সমগ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রাম করে আসছে। পরবর্তীতে যা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন অতঃপর স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেনÑ
‘আমি সেন্টিমেন্টালি বাংলাদেশের মানুষের সাথে এ্যাটাচ্ড্। কথাটা তোমাদের পরিষ্কার বলে দেবার চাই। তোমরা সকলে জান যে, প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। তোমরা সকলে জানতা, ইচ্ছা করলে আমি বহু আগে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। এ প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে কাঁটা বলে মনে হয়। আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তা হলে আমি শান্তিতে মরতে পারবো নাÑ পারবো নাÑ পারবো না। আমার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আমার যৌবন কারাগারের অন্তরালে কাটিয়ে দিয়েছি এ দেশের মানুষের জন্য। আমি ওদের কাছে থাকতে চাই, ওদের সাথে সাথে মরতে চাই, এর বেশি আমি আর কিছু চাই না।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দীর্ঘ ছয় বছর পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে বিদেশে নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেনÑ
‘বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি আপনাদের ভালবাসা নিয়ে। পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।
আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।’
বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলার মানুষের মুক্তি, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব তথা অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি আজ বিশ্ববাসীর কাছে রোলমডেল। বাংলার মানুষের মুখে আজ হাসি ফুটেছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশের মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাঙালি জাতিকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিজয় এনে দিয়েছেন। একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন আজ তা বাস্তবায়নও করছেন। তার যোগ্য নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বইতে শুরু করেছে পরিবর্তনের হাওয়া। প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেহারা। নিকট অতীতেও বাংলাদেশের নগর অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। গ্রামীণ জনপদ ছিল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পশ্চাৎমুখিতা, সুবিধাবঞ্চিত, অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা ক্লিষ্ট। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়Ñ ‘দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান কৌশল হবে কৃষি ও পল্লী জীবনে গতিশীলতা। হতদরিদ্রের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তৃত করা হবে।’ একই সাথে ইশতেহারে পল্লী উন্নয়নে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার পরিধি বিস্তৃত করার অঙ্গীকারও ঘোষণা করা।
বাংলাদেশের জনগণের নিকট করা আওয়ামী লীগের সে অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকৃতার্থেই, বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে দারিদ্র্য বিমোচনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার বিস্ময়করভাবে হ্রাস পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার এখন ২২.৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। ১ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। ৫ কোটি মানুষ নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো মানুষ আজ না খেয়ে থাকে না। খাওয়ার অভাব নায়Ñ মঙ্গা নাই, খড়া নাইÑ মারাত্মক কোনো দুর্যোগও নাই। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘হতদরিদ্রের হার কমাতে বাংলাদেশ যে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে, তা পুরো বিশ্বকেই আশাবাদী করে তুলেছে।’
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে ৩০ পদের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। টেলিমেডিসিন প্রকল্পের আওতায় ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও যে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭১.৮ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ১ লাখ পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ জনপদের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি আরও সহজতর হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে অটিটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপের ফলে অটিজমের মতো মানবিক স্বাস্থ্য সমস্যাটিও বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে আনা সম্ভব হয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের সুরক্ষায় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
চা-শ্রমিকদের অনুদান ১০ কোটি থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ কোটি করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ফেরা কার্যক্রম, দুস্থ ভাতাসহ ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রম থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সুবিধা পাচ্ছেন। সম্প্রতি ১০০টি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক উদ্বোধন করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখেরও বেশি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং গৃহায়ন কর্মসূচিসহ অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ২ লাখ ৮০ হাজার পরিবার পুনর্বাসন করার কাজ চলছে।
১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বয়স্কভাতা, বিধবা ও দুস্থ নারী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি চালু করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে চলতি বছর ১৪২টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই কর্মসূচি বাবদ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ২ লাখ ২৯ হাজার ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। হিজড়া এবং বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
২০০১-এ বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় শিক্ষার হার ৬৫ থেকে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। আর সেখানে বর্তমান শিক্ষার হার বৃদ্ধি করে ৭১ শতাংশে উন্নীত করেছে। গত সাত বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ২৪৩ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। শহরের নামি-দামি স্কুলে লেখাপড়া করা ধনি পরিবারের সন্তান এবং গ্রামের স্কুল পড়–য়া অতি দারিদ্র্য পরিবারের সন্তান একই দিনে, একই সাথে নতুন বই পাচ্ছে। বিদ্যালয়বিহীন ১ হাজার ১২৫টি গ্রামে নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ ও শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। ৩৫ হাজার ৫০০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার্থীরাও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কল্যাণে তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জন করে নিজেকে যুগোপযোগী করে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে মেধা ও যোগ্যতা বিকাশের অবাধ সুযোগ পাচ্ছে। তারা শহরে শিক্ষার্থীদের সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। তারা শহরের বড় বড় পদে চাকরি করছে। বড় বড় ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা।
দেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ৫৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে কৃষি খাতের উন্নয়নে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, কৃষি খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত বহুকৌণিক পদক্ষেপের ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে কৃষি ব্যবস্থায়। দেশে কৃষি খাতে অর্জিত হয়েছে ব্যাপক অগ্রগতি। কৃষি খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণির আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধিসহ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩ গুণ। শাক-সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থানে এবং মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ৪ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার ফলে অতিরিক্ত প্রায় ২১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ৭২৭টি কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হচ্ছে। গত আট বছরে প্রায় ৪০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বর্গাচাষিদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে বিনা জামানতে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় ১ কোটি গ্রামবাসী কৃষকের আছে নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উপার্জন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষির পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটছে। গ্রামে-গঞ্জে সম্প্রসারিত হচ্ছে ব্যবসায়িক কার্যক্রম। হাঁস-মুরগির পোল্ট্রি ফার্ম থেকে শুরু করে মৎস্য চাষ এমনকি গাড়ির বডি পর্যন্ত এখন গ্রামে তৈরি হচ্ছে। পোল্ট্রি ফার্ম ও ডেইরি ফার্ম, হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের ফার্ম এবং ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের মাধ্যমে উপার্জনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। পুরুষের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে স্বল্প পুঁজির নারী উদ্যোক্তা। এসব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কল্যাণে গ্রামের কর্মহীন নারীরাও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বাড়তি আয়ের মাধ্যমে সংসারের সচ্ছলতা আনছেন গ্রামের মহিলারা। গ্রামের মেয়েরা এখন সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যায়।
বদলে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের চেহারাÑ বদলে গেছে জীবনযাত্রার মান, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা। কুঁড়েঘরের জায়গায় এসেছে টিনের ঘর, টিনের ঘরের জায়গায় পাকা দালান। প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদনÑ পণ্য বিপণনও হয়েছে সহজতর। প্রত্যন্ত, দুর্গম এলাকার গ্রামও এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে শহরের সাথে। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোতে যেখানে প্রয়োজনীয় তেলের অভাবে কুপিবাতিও জ্বলত না, সেসব ঘরে এখন পল্লী বিদ্যুৎ অথবা সৌরবিদ্যুতের আলো ঝলমল করছে। বিদ্যুতের সাথে গ্রামে পৌঁছে গেছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, রেফ্রিজারেটরসহ আধুনিক ইলেকট্রনিক সামগ্রীও। যে গ্রামে ডাকচিঠি, টেলিগ্রাম, মানিঅর্ডার পৌঁছাতে অনেক দিন লেগে যেত, সেই গ্রামের অতি সাধারণ মানুষও এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। দেশের প্রত্যন্তাঞ্চলে নেটওয়ার্ক বিস্তার হওয়ায় মোবাইল সিমকার্ড ব্যবহারের সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৯ লাখেরও বেশি। আইটি ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে ১ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ৫ হাজার ডিজিটাল সেন্টার নির্মাণ করে ২০০ প্রকার সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০৯টি উপজেলাকে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। গ্রামে বসে শিক্ষিত যুবকরা আউটসোসিংয়োর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৬০০ মিলিয়ন ডলার। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তেই টাকা লেনদেন করতে পারছে শহর ও গ্রামের মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে গ্রামের স্বল্প-শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় অংশগ্রহণ। তারা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নিজের মতামত পোস্ট করে বিশ্বায়নের গতিধারায় যুক্ত হচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক। মফস্বলে পৌঁছে গেছে ই-কমার্সের সুবিধা।
বদলে গেছে গ্রামীণ বাজারের চেহারাও। প্রত্যন্তাঞ্চলের মুদি দোকানেও বিক্রি হচ্ছে শ্যাম্পু, সুগন্ধি সাবানসহ প্রসাধন সামগ্রী। গ্রামের মানুষ এখন আগাছা অথবা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে না, টুথপেস্ট-ব্রাশ না হলেও অন্তত টুথ পাউডার ব্যবহার করে। চিপস্, কোল্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, ফ্রুট ড্রিংকস এমনকি মিনারেল ওয়াটারও পাওয়া যায় গ্রামের দোকানে। এমনকি গ্রামের বাজারে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোনসহ অত্যাধুনিক বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীও পাওয়া যায়।
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এসব প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই গ্রামের বাসিন্দা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত এসব প্রবাসী শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থ পাল্টে দিচ্ছে গ্রামীণ জনপদের চেহারা। এখন গ্রামে গ্রামে নির্মিত হচ্ছে কয়েকতলা পাকা ভবন। যেখানে থাকছে বৈদ্যুতিক সংযোগসহ শহুরে জীবনের মতো আধুনিক-উন্নত নানা সুযোগ-সুবিধা। বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে মোটরসাইকেল; এমনকি কোথাও কোথাও বিলাসবহুল গাড়িও।
গ্রামের গরিব মানুষকে আধুনিক নাগরিক সুবিধাসহ ফ্ল্যাট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেখানে থাকবে বাজার, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, নিরাপদ পানি, সৌরবিদ্যুৎ, গবাদিপশু রাখার স্থান। গ্রামে আবাসন কমপ্লেক্স নির্মাণে ‘পল্লী জনপদ’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যাবে গ্রামীণ অর্থনীতিÑ সুখ, সমৃদ্ধি, শান্তি ও সচ্ছলতার উচ্ছলতায় ভরে উঠবে গ্রামীণ জীবন।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে একটি আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ডিজিটাল সেবা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামোসহ সকল খাতের সাফল্যের সুবিধা ভোগ করছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। বাংলার আকাশে-বাতাসে তাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑ
বদলে গেছে শহর-গাঁও
উন্নয়নের সোনার নাও।

Leave a Reply

%d bloggers like this: