বাংলাদেশের জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
ফরিদ হোসেন : বর্তমান শতাব্দীর শুরুটা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিকর ছিল না। বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল, এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ দুঃসময় পার করেছে। তখন সুসময় ছিল ইসলামি জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর। তখন ফুরফুরে মেজাজে ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারী শক্তি ও সংগঠনগুলো। তখন পোয়াবারো ডানপন্থি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সঙ্গে আঁতাতকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার, যেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামাতে ইসলামী দলটি দোর্দ- প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
বিএনপি-জামাতের আস্কারা ও সমর্থনে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় তখন জাম’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিষবাষ্প ছড়াতে শুরু করে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন জেএমবি ছাড়াও তখন বাংলাদেশে প্রচ- দাপটে কাজ করে মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ। এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রধান লক্ষ ছিল বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
আবদুর রহমানের পরিচালনায় জেএমবি গঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০০১ সালে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলা শহরে একযোগে ৫০০টি বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জেএমবি তার ভয়ঙ্কতার জানান দেয়। এর আগে ও পরে জেএমবি (এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাভাই নামের আরেক সন্ত্রাসী) দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন স্থানে আদালত ভবনে ও প্রাঙ্গণে বোমা হামলা করে। আইনজীবীসহ অনেকে নিহত হন। দেশে-বিদেশে হামলা ও জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার জোট সরকারের জামাতি মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী বোমা আক্রমণসহ সন্ত্রাসী কর্মকা-কে ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে উড়িয়ে দেন, যদিও শেষ পর্যন্ত বিশেষত আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথা নত করে তিনি জেএমবি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন ও আবদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করেন। কয়েকজনের ফাঁসির দ-ও কার্যকর করা হয়।
তবুও জেএমবি ও হরকাতুল জেহাদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে বিএনপি তার আদর্শগত সম্পর্ক পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারে নি। বিশ্লেষকদের মতে, জামাতে ইসলামী দলটির সাথে বেগম জিয়ার কৌশলের চেয়ে অধিক আদর্শগত সম্পর্কের কারণে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো গোপনে তাদের কর্মকা- অব্যাহত রাখে, সুযোগ বুঝে মাথা চাড়া দেওয়ার ক্ষণ গুনতে থাকে। বিএনপি জোট সরকারের ২০০১-০৬ সালের শাসনামল বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর জনসভায় বোমা হামলা (মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ ২৩ জন নিহত ও অসংখ্য নেতাকর্মী আহত) সারাবিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল।
২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দেন একটি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার আহ্বানে তুমুল গণ-আন্দোলনে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন একটি সামরিক সমর্থিত জরুরি প্রশাসনের কাছে, যা ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন সরকার বা জরুরি অবস্থার সরকার নামে পরিচিত। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ, সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মহাজোট সরকার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হলো।
শুরু হলো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের নতুন ও দৃপ্ত অভিযান। সন্ত্রাসী শক্তিকে ঝেটিয়া বিদেয় করার জন্য সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। ফলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর, বিশেষ করে জামাত ও বিএনপি আশীর্বাদপুষ্ট জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদ ছিন্নভিন্ন হলো। তবে নিশ্চিহ্ন হলো না। ধ্বংসাত্মক আদর্শভিত্তিক এই ধরনের ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তি কোনোকালেই কোনো দেশে শুধু নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা নির্মূল করা যায় না। শেখ হাসিনা সরকারের অব্যাহত দৃঢ় অভিযানের ফলে বাংলাদেশের ধর্মীয় জঙ্গিদের একটা বড় অংশ প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেয়। গত ২ অক্টোবর বর্ধমানের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে দুই জঙ্গি নিহত হয়। পুলিশ রুমি বিবি ও আমেনা বিবি নামের দুজন নারী জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন, এ দুই নারী জঙ্গি শেখ হাসিনার সরকারের তাড়া খেয়ে অনেক আগেই ভারতে পালিয়ে যায় অন্য জঙ্গিদের সাথে। এরা পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্থানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলেও ভারতীয় গোয়েন্দারা জানাচ্ছে।
বর্ধমানের বিস্ফোরণ জেএমবির আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে ভারতের ইসলামি মুজাহিদীন (আইএম) ও আল-জিহাদ জঙ্গিদের। আল-জিহাদ একটি নবাগত সংগঠন যার সম্পর্ক রয়েছে সিরিয়াভিত্তিক ইসলামিক স্টেট (আইএস) সন্ত্রাসীদের। আইএসের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন দুজন সন্দেহভাজনকে বাংলাদেশে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এদের বেশিরভাগই জামাত ও বিএনপির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জড়িত। বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া যে তিনি জঙ্গিদের সাথে হাত মিলাতে দ্বিধা করছেন না। অন্যদিকে জঙ্গিদের সাথে জামাতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সম্পর্ক। তাই শেখ হাসিনার সরকার যখন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার চলছে তা নস্যাৎ করার জন্য জামাত মরিয়া। জামাতকে সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি ও দলটির নেতা খালেদা জিয়া।
মোদ্দা কথা হলো, জঙ্গিরা নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং ঘাপটি মেরে আছে দেশের ভিতরে ও বাইরে। জঙ্গিদের একটি অংশ আইএস ও আল-কায়দার মতো দুর্ধর্ষ আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পেরেছে। ফলে, জঙ্গি দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অভিযান যে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে সন্দেহ নেই। আশার কথা, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো সজাগ রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, সাবেক ব্যুরো প্রধান, এপি