বাংলাদেশের স্থপতি = বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনিই বাংলাদেশের স্থপতি। দেশের সর্বস্তরের মানুষ তখন তার নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেন। তার নেতৃত্বে প্রতিটি মানুষ যেমন আস্থা রেখেছিলেন, তিনিও তেমনি মানুষের সে আস্থার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। দেশের জন্য তার আত্মত্যাগ অতুলনীয়।
বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন, তা নস্যাত্ করতেই তাকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে তার আদর্শের ওপর আঘাত নেমে আসে। তবে এ কথা আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, তার হত্যাকারীরা বাংলাদেশ থেকে তার আদর্শ বিনষ্ট করতে সমর্থ হয়নি। মানুষ বর্তমানে যেভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, সেভাবে তার আদর্শকেও রাষ্ট্রীয় জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনায় যেসব মূলনীতি প্রণয়ন করেছিলেন তা পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বিকাশ লাভ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যক্ত ছিল। তারপরও ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন তার ঐতিহাসিক প্রমাণাদি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যারা তা মানতে চান না, তারা ইতিহাসের সত্যকেই অস্বীকার করেন।
স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের ক্ষমতাকালে একটি আদর্শ সংবিধান প্রণয়ন এবং শিক্ষা-শিল্প-বাণিজ্য-পররাষ্ট্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিও বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু ঘাতকের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তেমনি পরিত্যক্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব হবে।
এ কথা স্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর নিন্দুকেরা জাতিকে অনেকখানি বিভক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। তাই এখন আমাদের কর্তব্য হবে- বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের সেই জাতীয় ঐক্য যতদূর সম্ভব প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি বেঁচে থাকলে আজ অন্যরকম হতো দেশ
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রায় নয় মাস আগের কথা, রমনা পার্কের পাশে সে সময়ের বেশ কয়েকজন স্থপতির সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। সেই মিটিংয়ে তিনি দেশকে নিয়ে মহাপরিকল্পনার অনেক কিছুই আলোচনা করেন। তিনি বলছিলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশের জমি ইঞ্চি ইঞ্চি করে ধরে পরিকল্পনা করতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, এর পাশাপাশি ভৌত পরিকল্পনা করতে হবে বিশদ আকারে।’ বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনে এজন্য ভৌত বিষয়ক মন্ত্রণালয় পৃথক করার কথাও বলেন। সেদিনের মিটিংয়ে ছিলেন স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম, স্থপতি রবিউল হুসাইন, স্থপতি শামসুল ওয়ারেস, স্থপতি মোবাশ্বির হোসেন প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা যে কত বিস্তৃত, তা তার পরিকল্পনার ধরন দেখেই আঁচ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমাকে দু-একটি মহকুমার কিছু গ্রামভিত্তিক পরিকল্পনা করে দেখান।’ গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন নিয়ে তিনি সবসময় ভাবতেন। সেই মাফিক কাজও শুরু হয়েছিল, তার আশা ছিল, সফল হলে এই পরিকল্পনা সারাদেশে বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের এরকম শত শত অবাস্তবায়িত স্বপ্ন অধরা রেখে তিনি চলে গেলেন, তাকে চলে যেতে হলো।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট আমরা জাতীয় জীবনে বড় এক হোঁচট খেলাম। সেখান থেকে আমরা বারবার উত্তরণের চেষ্টা করেছি বটে, কিন্তু সময় তো থেমে থাকেনি। কাজেই পিছিয়ে পড়েছি আমরা।
তবে আশার বিষয়, বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর সেই অবাস্তবায়িত স্বপ্ন নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। সেই সময়ের যে আধুনিক কর্মপরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, সেগুলো এখন এসে আমরা ভাবছি। পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা এখন বাংলাদেশের এই সীমিত জমিকেই কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবছি। এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা না, জোনিং করে সামগ্রিক উন্নয়নকে জোর দেওয়া হচ্ছে। শুধুই শহর বা নগর কেন্দ্রিক নয়, গ্রামীণ জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে নিয়েও একাধিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এখন শুধু এই পরিকল্পনাগুলোকে শাণিত করা দরকার, আমাদের এগিয়ে যাওয়া যেন কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির সুবিধার জন্য না হয়। সব শ্রেণি পেশার মানুষেরই তো এই দেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম, সেখানে তো সবার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। দুঃখের বিষয়, আজ তার মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরে এসেও আমাদের আফসোস করতে হয়, কেন এখনো সেই সমঅধিকার এল না। আজ যদি তিনি থাকতেন, নিশ্চয়ই বাংলাদেশ অন্যরকম হতো।
মানুষকে আপন করার জাদুকর ছিলেন বঙ্গবন্ধু = ড. কামাল হোসেন
তিনি বললেন, ‘আমরা কী ধরনের সরকার গঠন করব? আমাকে যদি বলো, আমি পার্টি নিয়ে থাকতে চাই। সরকার গঠন করুক আমার দলের অন্য নেতারা। আমি সবাইকে নিয়ে ঐক্য করা এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’ আমি বললাম, এটা ঠিকই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের আরেক নাম হলো শেখ মুজিব। সুতরাং আপনি রাষ্ট্রপ্রধান, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী না হলে সমস্যা হবে।
মুসলিম লীগে তরুণ যাঁরা ছিলেন কি মুজিব ভাই, কি তাজউদ্দীন ভাই, এঁরা বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কমান্ডোদের বলেছিলেন, আমরা আওয়ামী লীগ গঠনের মাধ্যমে সংগ্রাম করেছিলাম কৃষকের পক্ষে, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এবং প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের পক্ষে। পাকিস্তানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের দল ক্ষমতায় থাকলে আমরা সবকিছু করতাম জনগণের জন্য, সমাজ পরিবর্তনের জন্য এবং সর্বোপরি গরিব মানুষের জন্য একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য। কিন্তু আমরা ২৪ বছরে দেখলাম, আমাদের নির্বাচনই করতে দেয়া হয়নি। তারা মন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনছিল। পরে বলল, এগুলো তো আমাদের কেউ বলেনি। আরো বলল, হুকুম দেন। আমরা জেনারেলদের মেরে ফেলব। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে দেখলাম, তার মধ্যে পরকে আপন করার এক অসাধারণ গুণ ছিল।
তারপর শুরু হলো আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি আমাদের ফেরার ব্যবস্থা করবে। পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ এসে বলল, ইরান, তুরস্ক হয়ে আপনাদের ফেরার ব্যবস্থা করছি। আমরা বললাম, সরাসরি আমাদের নেবে না কেন? তিনি বললেন, ভারতের ওপর দিয়ে তো আমাদের প্লেন যাবে না। আমি তাঁকে বললাম, জাতিসংঘ কিংবা রেডক্রসের প্লেন তো যেতে পারে। তখন তিনি বললেন, আমরা চাই, আমাদের প্লেনেই আপনাদের পৌঁছে দেবো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ইরান কিংবা তুরস্ক নিয়ে গেলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বলো যে, জেনেভার মতো নিরপেক্ষ একটা জায়গায় নিতে। তখন আজিজ সাহেব বললেন, লন্ডনে নিলে কেমন হয়? বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, মেনে নাও এটা। আমি বললাম, তাহলে লন্ডনে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনে আমরা ৮ তারিখে পৌঁছেছি। বলা হয়েছে, প্লেনে নেয়া হবে, তবে প্লেন ল্যান্ড করার ১ ঘণ্টা আগে জানানো হবে ব্রিটিশ সরকারকে। যথারীতি আমরা নামি লন্ডনে। নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভিআইপি রুমে। দেখি যে, ওখানে ছয় ফুট লম্বা একজন পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এক ধাপ আগ বাড়িয়ে স্যালুট করে বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, স্যার, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছিলাম। এ ঘটনাটা বলছি এ কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি পৃথিবীর মানুষের অন্তর থেকে সমর্থন ছিল। আমরা রুমে ঢুকলে ওখানকার কর্মকর্তারা আমাকে টেলিফোন ধরিয়ে দিলেন। ওপার থেকে বলছে, এখানে কি শেখ মুজিবুর রহমান আছেন? আমি নিজে পরিচয় দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, আছেন। ওপার থেকে বলছে, তাঁকে জানিয়ে দাও, ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বরণ করবে, থাকার ব্যবস্থা করবে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দেখা করবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাইদ চৌধুরীর নম্বর দিতে বলো। আমি তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আবু সাইদ চৌধুরী গতকালই চলে গেছেন। আমি বললাম, এর পরিবর্তে কে আছে, তার নম্বর দাও। পরে তিনি আমাকে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেজাউল করিমের নম্বর দিলেন। আমি তাঁকে ফোন করি। তিনি শুনেই কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি এক্ষুনি আসছি। তিনি আসতে আসতে ওই লোকটিও চলে এলেন। আমাদের গাড়িতে তুললেন, রেজাউল করিম সাহেবও উঠলেন। লোকটি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনাকে ক্লারিজ হোটেলে (লন্ডনে তখন এটি ছিল এক নম্বর হোটেল) নিয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাকে লোকটিকে বলতে বলল, এমন দামি হোটেলে নয়। রাসেল স্কয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটা সাধারণ হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা যেন করে। ওখানে আমাদের লোকজন আছে। তাদের আসতে যাতে সুবিধা হয়। এটা শুনে তিনি হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, স্যার, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমরা আপনাকে নিচ্ছি। সব কথা আমরা মেনে নিচ্ছি। এ কথা মেনে নেয়া যাবে না। কারণ রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য যে বিশেষ হোটেল আছে, সেখানে তাঁদের ব্যাপক নিরাপত্তা আছে। বললেন, সেখানেই আপনার সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের দেখা করার ব্যবস্থা করব। পরে ওখানে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা হলো। দেখা গেল, সেখানে শত শত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসতে লাগল। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। কারণ এত লোক তো হোটেল কর্তৃপক্ষ জীবনে দেখেনি। তারা বলছে, এখানে নিরাপত্তার সমস্যা হবে। আমাকে বলছে, আপনি আমাদের সঙ্গে গেটে দাঁড়ান। আপনি দেখে দেখে ঢুকতে দেবেন। তখন আমার কাজ হয়ে গেল সামনে দাঁড়িয়ে লোক সরিয়ে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে এলেন হ্যারল্ড উইলসন (ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতা, পরে প্রধানমন্ত্রী), এরপর বেগম আবু সাইদ চৌধুরী, এরপর ডেভিড ফ্রস্ট (বিখ্যাত সাংবাদিক)। ওঁরা খবর দিলেন, ওইদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তার আগেই দুপুরের দিকে প্রেস কনফারেন্স। আমাকে বললেন, এ পয়েন্টে তুমি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করো। প্রথমত, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাও। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা কিংবা সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং যেসব দেশ সমর্থন করেনি অথচ মানুষ সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাও। তৃতীয়ত, সব দেশের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি চাও এবং চতুর্থত, পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য চাও। মূলত এ চারটি পয়েন্ট ধরে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর ভাষণ তুলে ধরেন।
বিকেল ৪-৫টার দিকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী হিথ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের খুব গভীর আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, আপনাকে জানোনো হয়েছে, আমরা আপনাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবর্ধনা দিচ্ছি। আমরা আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তা করছিলাম এবং এখন আমাদের মাঝে আপনাকে পেয়ে আনন্দ পাচ্ছি। যত দূর সম্ভব আপনাকে সাহায্য করব। বঙ্গবন্ধু বললেন, তা তো করবেনই। আমরা আপনার দেশের স্বীকৃতি চাই। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবর্ধনা দিচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবো ইইউর অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে। এজন্য ১০-১৫ দিন সময় লাগতে পারে। সুতরাং ধরে নেন যে, আপনি স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছেন। আর পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্যও যা সম্ভব সহযোগিতা করব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সাহায্য লাগবে? বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি কি আমাদের প্লেন দিয়ে সাহায্য করবেন? কেননা আমি দ্রুত বাংলাদেশে যেতে চাই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বললেন, অবশ্যই। হিথ সাহেবও তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, দেখো, আমার প্লেন ওখানে ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আধঘণ্টা পর হিথ সাহেবের সেক্রেটারি এসে বললেন, কাল সকালে আপনার প্লেন রেডি হতে পারে। তাত্ক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল ৭টায় আমরা রওনা হয়ে যাব। বাংলাদেশ থেকে প্লেন গেলে আমাদের আরো দু’দিন লন্ডনে থাকতে হতো। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকজন আসবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়, যত দ্রুত বাংলাদেশে যেতে পারি, সেটাই হবে আমাদের অগ্রাধিকার। পরে আমরা দিল্লি থামলাম। দিল্লির দৃশ্যটা আমার এখনো মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে তারা এমনভাবে সংবর্ধনা জানালেন, যেন তিনি পরিবারের একজন সদস্য। মিসেস গান্ধীসহ অনেকের চোখে পানি পড়ছে। ওখানে তিনি বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। পরে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আমরা দেশে ফিরে এলাম।
প্লেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একটি ট্রাক এল। সেখানে ছিলেন তাজউদ্দীন ভাই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ও ছাত্রনেতারা। আমরা ট্রাকে উঠলাম। ওপর থেকে দেখলাম, জনসমুদ্র। গাছের ওপরে, ছাদের ওপরে সবখানেই মানুষে ঠাসা। নামতে নামতে আমাকে বঙ্গবন্ধু দুটি বিষয় বললেন। তিনি বললেন, ‘আমরা কী ধরনের সরকার গঠন করব? আমাকে যদি বলো, আমি পার্টি নিয়ে থাকতে চাই। সরকার গঠন করুক আমার দলের অন্য নেতারা। আমি সবাইকে নিয়ে ঐক্য করা এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’ আমি বললাম, এটা ঠিকই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের আরেক নাম হলো শেখ মুজিব। সুতরাং আপনি রাষ্ট্রপ্রধান, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী না হলে সমস্যা হবে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি না প্রধানমন্ত্রী হব? তখন বললাম, ছয় দফার মধ্যে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। আপনি রাষ্ট্রপতি হলে সংসদীয় ব্যবস্থা লালন করা কঠিন হবে। কারণ পাকিস্তানের একটা অভিজ্ঞতা ছিল, সব ফাইল চলে যেত জিন্নাহর কাছে। এজন্য সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আরো বললাম, আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানেই সব ক্ষমতা থাকবে। আপনি যদি রাষ্ট্রপতি হয়ে যান, তাহলে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনি নামলেন। পরে ১০ জানুয়ারির সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানে থাকাকালে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঢাকায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এর উত্তর দেবো। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘ভুট্টো, তুমি তো আমাকে বলেছিলে কিছু সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে। আমি আজ এখানে এসে দেখেছি, শুনেছি, বুঝেছি কী ধরনের আক্রমণ চালানো হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে। এরপরও দেখো, আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক হোক, এটা আমি চাই। কিন্তু সেটা হবে দুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। তোমাদের দেশের মানুষ ভালো থাকুক, এটা চাই। এছাড়া অন্য কোনো ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ক হবে না।’
জাতির জনকের সংগ্রামমুখর দিনগুলো = তোফায়েল আহমেদ
পনেরোই আগস্টের কালরাত্রিতে শাহাদাত বরণকারী সকলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভীড় করে আসে। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না— আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ কত বিশাল হূদয়ের মহত্ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচিতি হবার পর থেকে আমি তাঁর অপার স্নেহ-ভালোবাসায় ধন্য। তিনি সবসময় আমাকে কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার সুবাদে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আজ স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলোর দৃশ্য। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হয়েছেন। সে-সময় বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছে— ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’। এই সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের পরমমিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। সেকি বক্তৃতা! কলকাতার মানুষ সেদিন বাড়ি-ঘর ছেড়ে জনসভায় ছুটে এসেছিল। সভাশেষে রাজভবনে যখন দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা হয়, তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন।
১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্যদিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দুই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোঞ্জ টিটো। আর প্রয়াত ৪ জন নেতা ছিলেন মিশরের জামাল আব্দুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট। আমার বাসা ছিল ধানমন্ডিতে— এখন যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়, তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বাসভবন— সেটিই ছিল তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের বাসভবন। প্রতিদিনের মত সকাল বেলা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলাম। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসাথে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব— যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এরপর এসে গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকেলে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসাথে চা পান করতেন। এরপর রাত ৮টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসাথে ফিরতামও একসাথে। গণভবনে যেখানে বঙ্গবন্ধুর অফিস ছিল সেখানে তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করতেন। গণভবনের পাশে এখন যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম এবং ব্যক্তিগত সচিব ফরাসউদ্দীন এই দুজন পিএইচডি করতে বিদেশ যাবেন এই উপলক্ষে কর্মকর্তাদের নৈশভোজ। নৈশভোজ শেষে তাদেরকে বিদায় করে আমি আবার ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সাথে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষের পাশেই আমার দপ্তর। সেদিন কাজ শেষে সকলকে বিদায় করে আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সাথে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সাথে তোর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবি।’ নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।
পরদিন ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় এজেন্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্য জাতির জনককে সপরিবারে ১৭ জন সদস্যসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ভোর থেকেই দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই আমাকে প্রথমে গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করা হয়। ধানমন্ডির যে বাসায় আমি থাকতাম— সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বাসায় কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেয়া হয়নি। দুই দিন পর ১৭ তারিখ খুনিচক্রের অন্যতম ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল সদস্য আমার বাসভবন তছনছ করে। ঘরের দেওয়ালে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো ভেঙে ফেলে। মায়ের সামনেই হাত-চোখ বেঁধে আমায় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনিচক্রের সমর্থনে সম্মতি আদায়ে উপর্যুপরি নির্যাতন চালায়। তখনও জেনারেল শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল ব্রিগেড কমান্ডার। তাদের হস্তক্ষেপে আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর ২৩ তারিখ ই. এ. চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমাকে এবং জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক তার অবৈধ সরকারকে সমর্থন করার জন্য আমাদের দুজনকে প্রস্তাব দেয়। আমরা খুনি মোশতাকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। এরপর আমাকে গৃহবন্দী করা হয়। সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ জিল্লুর রহমান, আমাকে ও আবদুর রাজ্জাককে একই দিনে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দী রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমাদের সাথে আর একজন বন্দী ছিলেন। তিনি ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক আবিদুর রহমান। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে পাশাপাশি দুটি চৌকির একটিতে ঘুমাতাম আমি ও রাজ্জাক ভাই এবং অপরটিতে জিল্লুর ভাই ও আবিদুর রহমান। পরদিন অর্থাত্ ১২ সেপ্টেম্বর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফাঁসির আসামীকে অন্ধকার নির্জন প্রকোষ্ঠে যেভাবে রাখা হয় ময়মনসিংহ কারাগারে আমাকেও সেইভাবে বন্দী করে কনডেম সেলে রাখা হয়। তিন মাস আমি সূর্যের আলো দেখিনি। আমার সাথে তখন কারাগারে বন্দী ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানসহ অনেকে।
কুষ্টিয়া কারাগারে আটকাবস্থায় ’৭৭-এর ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক সেকশন অফিসার কর্তৃক ব্যাকডেটে স্বাক্ষরিত অর্থাত্ ’৭৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করা আটকাদেশের সত্যায়িত কপি আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। আটকাদেশের সত্যায়িত কপি প্রাপ্তির পর আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমার পক্ষের আইনজীবীগণ। অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ১৯৭৮-এর ১২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাসসহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি লাভ করি। কুষ্টিয়া কারাগারে যখন বন্দী তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় এবং কারাগারে আটকাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই।
কারামুক্তির পর দেখলাম জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি। আমরা তার সামরিক শাসনের মধ্যেই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। ঢাকায় ১৯৮০ সালে রাজশাহী কারাগারে জেলহত্যার বিরুদ্ধে আমরা যে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছিলাম, সেই মিছিলে আমি আর রাজ্জাক ভাই নেতৃত্ব দিয়েছি। সামরিক সরকার মিছিলের উপর ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান ছিলেন নীতিহীন স্বৈরশাসক। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘I will make politics difficult for politicians’ এবং এই নীতিহীন প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন।
এরকম দুঃসহ অবস্থার মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সাংগঠনিক তত্পরতা বৃদ্ধি করে সকল ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দলের সংগ্রামী পতাকা গৌরবের সাথে সমুন্নত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হবার পর আমরা তাঁকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সর্বস্তরের গণমানুষের সমর্থন পেয়েছি। ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সংবিধান ও সত্যের কাছে আমাদের অঙ্গীকার ও দৃঢ় মনোবল। ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। প্রথমেই তিনি সংবিধান থেকে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম করেন। ’৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর সামরিক শাসকেরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শুধু ক্ষমাই করেনি বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছে। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। ২০০১-এ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছে। ২০০৯-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যদিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ সমাপ্ত করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। খুনিচক্রের যারা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমরা তাদের দেশে এনে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার চেষ্টা করে চলেছি।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ট্রানজিস্টার = মনি হায়দার
শফি তালুকদারের তালুকদারি এখন নেই। এখন কি, কখনোই তালুকদারি ছিল না। নামেই কেবল তালুকদার। অবশ্য দাদা কোরবান তালুকদারের মুখে শুনেছে, কোনো এক কালে নাকি তারা অনেক বড় তালুকদার ছিল। শত শত বিঘা জমির মালিক ছিল। বছরের নির্দিষ্ট দিনে প্রজারা খাজনা দিত। গোলা ভরা ছিল ধান। এলাকার লোজজন সম্মান করত। কোথায় সেসব তালুকদারি হারিয়ে গেছে, জানে না শফি তালুকদার। জন্ম থেকেই দেখেছে টেনেটুনে জীবন চলছে। বাবা দয়াল তালুকদার হালটাল করে সংসার চালাচ্ছে। বাড়ির কাছে বোথলা হাইস্কুল থেকে মেট্রিকটা পাস করলেও বাবার সঙ্গে ক্ষেতে খামারে কাজ করেছে। সেই কাজ এখনো সে করছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সকালের দিকে শফি তালুকদারের বোথলা বাজারে আসা চাই, কেবল জাকিরের দোকানের এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। আজও চা খাচ্ছিল সে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকায় সাদাকালো টিভির দিকে। নিচের স্ক্রলে নানা সংবাদ একের পর এক ভেসে উঠছে। হঠাত্ একটা সংবাদে চোখ আটকে যায় শফি তালুকাদের, আগামীকাল…।
সঙ্গে সঙ্গে শফি তালুকদারের বুকের মধ্যে অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকা একটা সিংহ বিকট শব্দে জেগে ওঠে। শব্দটা তাকে কাঁপিয়ে দিলেও সেই শব্দটা কেবল শফিই শুনতে পায়। দ্রুত চা খেয়ে জাকিরকে টাকা দিয়ে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। বোথলা বাজার থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এক প্রকার দৌড়ে বাড়িতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে স্ত্রী হালিমাকে ডাকে, ‘এই এদিকে আসো।’
হালিমা গরুর গোয়াল থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়ায়, ‘কী অইচে আপনের?’
কয়েক মুহূর্ত স্ত্রী হালিমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাগো রেডিওটা কই?’
‘রেডিও?’ হালিমা হাতের আগল নিচে নামিয়ে রেখে তীক্ষচোখে স্বামীর দিকে তাকায়, ‘কীয়ের রেডিওর কতা কইতেছেন আপনে?’
‘আমাগো বাড়িতে একটা রেডিও ছিল না? আমরা হারাদিন গান-বাজনা হুনতাম…’
হালিমা বেগম অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, মানুষটা কি কোনোদিন মানুষ হবে না? সেই একুশ-বাইশ বছর আগের রেডিও কি এখনো আছে? আর রেডিও তো এই মানুষটাই বন্ধ করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আমার ঘরে আর রেডিও বাজবে না।’
সারাদিন-রাত, যতক্ষণ যন্ত্রটার ভিতরে গান আর অনুষ্ঠান হতো, খোলাই থাকত। হাঁটতে বসতে কাজ করতে করতে কত নাটক শুনেছে। আরও শুনেছে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাত্কার। কেবল কি ঘরের মানুষে শুনেছে? আশপাশের দুই-চার বাড়ির মানুষও শুনেছে। রেডিওটা তো খায়েরের বাবাই কিনে এনেছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে আসার পর। বাড়ির সবাই আনন্দে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল। সবাই টানাটানি করলে খায়েরের বাপ বলেছিল, ‘তোমরা যা ইচ্ছা হোনো, আমি হুনবো শেখ মুজিবরকে।’
সেই সময়ে রেডিওতে প্রায়ই শেখ মুজিবের কণ্ঠ শোনা যেত, সন্ধ্যার দিকে। সারাদিন কাম-কাজের পর সন্ধ্যা হলে মানুষটা রেডিওটা নিয়ে ঘরের বড় চৌকিতে শুয়ে থাকত। রেডিও শুনতে শুনতে রাতের ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে যেত।
সকালে উঠে কাজে চলে গেলে, আর সারাদিনে রেডিওটার খবর থাকত না। একবার পাশের বাড়ির জয়তুনের মায়ের পায়ে ধাক্কা লেগে রেডিওটা বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে খায়েরের বাবা শফি তালুকদার নব ঘুরায় রেডিওর, চড় চড় শব্দ হয় কিন্তু কথা শোনা যায় না। যে মানুষটা কথা বলে না প্রায়ই কারো সঙ্গে, থাকে চুপচাপ, সেই মানুষটা রাগে কেঁপে উঠল, ‘রেডিও কতা কয় না ক্যা?
ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় হালিমা, ‘ওটা তো যন্ত্রর। যন্ত্রর নষ্ট অইতে পারে না? হারাদিনই তো বাজে…
‘বাজান!’ ছয় বছরের খায়ের গলা বাড়ায়, ‘ওই বাড়ির জয়তুনের মায়ে পা দিয়া লাড়া দিছে।’
শফি ভাটার চোখ নিয়ে তাকায় স্ত্রী হালিমার দিকে, ‘তুমি আমারে ছাগল পাইছ? আর ওই খাটাইসা বিডি আই