বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু
একটি দেশে সরকার থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের নেতার নির্দেশে সে দেশ চলার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে নেই। কিন্তু একাত্তরের মার্চের ২৫ দিন সামরিক সরকারের কোনো নির্দেশ পূর্ব বাংলার জনগণ শোনেনি বা মানেনি। শেখ মুজিব ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, বাংলার মানুষ বিনাবাক্যে তা মেনে নিয়েছে।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। আর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর নয়, হাজার বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশ। শত বছর আগে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামসহ বহু জানা-অজানা তরুণ, যুবক-যুবতী আত্মাহুতি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করে গেছেন।
এটা ঠিক, বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন ভূখ- প্রতিষ্ঠার জন্য শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীসহ আরো অনেক নেতা শত বছরের মুক্তিসংগ্রামে বিভিন্নভাবে তাদের অবদান রেখেছেন। সর্বশেষ বাঙালির অমৃতের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে না দেওয়ায় বেতার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ বন্ধ রেখে রাজপথে নেমে আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা এলে বাবুর্চিরা রান্না করে খাওয়াতে অস্বীকার করেন। মুজিবের আহ্বানে পরে তারা সম্মত হন। গভর্নর টিক্কা খানকে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী শপথবাক্য পাঠ করাননি। ১ থেকে ২৫ মার্চ রাত ১২টা পর্যন্ত এই বাংলায় মুজিবের শাসন কায়েম ছিল। ২৩ মার্চ ৩২ নম্বরের বাসভবনে মুজিব নিজে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা এলে স্বাধীন দেশের সরকারপ্রধানের মতো শেখ মুজিব তাকে ‘বাংলাদেশের অতিথি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ২৫ মার্চ রাতে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সাহসের বরপুত্র মুজিব পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে গ্রেফতারবরণ করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিনেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আর ওই সময় শেখ মুজিব স্বাধীন দেশের সরকারপ্রধানের মতোই দেশ পরিচালনা করেন। আক্রান্ত হওয়ার পর বাংলার মানুষ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বা অন্য কোনো ছলিমদ্দি-আলিমুদ্দির ঘোষণার অপেক্ষা করেনি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার ইপিআরসহ সারা বাংলায় মানুষ পাকিস্তানি দস্যুদের হামলার পাল্টা জবাব দেয়।
বাঙালি জাতির সৌভাগ্য শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন অসাধারণ নেতা পেয়েছিল। সাহস, শৌর্য-বীর্য, দূরদর্শিতা, যোগ্যতা ও দেশপ্রেমে তার কোনো তুলনা হয় না। পাকিস্তানের ২৩ বছরে বহুবার তিনি জেলে গেছেন। আজকের দিনের রাজনীতিকদের মতো তিনি পালিয়ে বেড়ানোর রাজনীতি করতেন না। সত্যিকার অর্থেই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন শেখ মুজিব। বাংলার মানুষ ভালোবেসে তাকে উপাধি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু।
‘৭০-এর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে। আর পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ আসন। ‘৭০-এর নির্বাচনে মুজিব-ঝড়ে অন্যসব রাজনৈতিক দল ও নেতা কুপোকাত হয়ে যায়। নির্বাচনে প্রমাণ হলো, পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার একমাত্র অধিকার রয়েছে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের; অন্য কারো নয়।
নির্বাচনের পর ‘৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ পড়ান বঙ্গবন্ধু। শপথকালে বাংলার মানুষের কাছে ওয়াদা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার দাবি-দাওয়ার সঙ্গে কোনো আপস করলে আপনারা আমাদের জ্যান্ত কবর দেবেন।
২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখা গেল। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সমাবেশে অনির্ধারিতভাবে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধু। মঞ্চে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। সভায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ঘোষণা এবং কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। সভায় আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যদি নাও থাকি তাহলেও সংগ্রাম চলবে।’
৩ মার্চ থেকে সারা দেশে ৬টা_২টা হরতাল শুরু হলো। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আর দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।… এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলো। ১ থেকে ২৫ মার্চ_ এই ২৫ দিন পূর্ব বাংলায় সামরিক সরকারের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সে সময় শেখ মুজিবের কথাই ছিল আইন।
পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকা এলেন। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী গভর্নরকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করলেন। এভাবে পিয়ন থেকে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে চলতে লাগলেন? ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করলেন। এ নির্দেশ মোতাবেক দেশ চলতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হলো, ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসতে দেয়া হবে না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ব্যারিকেড তুলে নেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে ঘোষণা করলেন।
সে সময় শেখ মুজিব হয়ে গেলেন পূর্ব বাংলার একমাত্র অধিপতি। জনগণনন্দিত নেতা। ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে শেখ মুজিবকে অনুনয়-বিনয় করে বলেন, তিনি যেন ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে স্বাধীনতা ঘোষণা না করেন। ৭ মার্চ সকালে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা না করার অনুরোধ জানান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এটা বলতেও ভুল করেননি, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবে না।
পূর্ব বাংলায় সামরিক শাসনের পরিবর্তে মুজিবের শাসন প্রবর্তিত হলো। ঢাকায় সে সময় কর্মরত পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক তার ্তুডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ্থ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সংহত করার জন্য একের পর এক নির্দেশ জারি করে চলল। এসব নির্দেশ সমাজের সর্বস্তরে তথা সরকারি অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রেই মেনে চলা হলো। এমনকি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও এবং টেলিভিশন মুজিবের আদেশ মেনে চলল। সারা প্রদেশকে গ্রাস করল মুজিবের শাসন। শুধু গ্রাস করতে পারল না প্রদেশের সাতটি সেনানিবাসকে।’
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আসগর খান ‘৭১-এর মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তানে সেনানিবাসগুলো ছাড়া সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা গেছে।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য দেখে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা ওয়ালি খান বলেছিলেন, ‘মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে বেশি সফল।’
একটি দেশে সরকার থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের নেতার নির্দেশে সে দেশ চলার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে নেই। কিন্তু একাত্তরের মার্চের ২৫ দিন সামরিক সরকারের কোনো নির্দেশ পূর্ব বাংলার জনগণ শোনেনি বা মানেনি। শেখ মুজিব ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যে নির্দেশ দিয়েছেন বাংলার মানুষ বিনাবাক্যে তা মেনে নিয়েছে।
১৫ মার্চ, ১৯৭১। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয় সশস্ত্র পাহারায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে পেঁৗছানোর কথা। পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুরের শাসন চলছে, তার নির্দেশে সবকিছু হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক পেগি ডারডিন মার্চের সেই উন্মাতাল দিনগুলোর বর্ণনায় লিখেছেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশাবলি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছে। এ নির্দেশাবলি প্রয়োগের জন্য এই নেতার কোনো বাহিনী বা প্রশাসন ছিল না। এই স্বতঃস্ফূর্ত নির্দেশ মানার পেছনে ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বাঙালি জাতির ও নেতার মধ্যে একটি অলিখিত অথচ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অঙ্গীকার।’ (সূত্র : সোহরাব হাসানের ‘মুজিব-ভুট্টো-মুক্তিযুদ্ধ’, পৃষ্ঠা ১৭৫)
৮ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে, ‘মনে হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ ১৫ মার্চ, ১৯৭১।
বিখ্যাত ‘টাইম’ সাময়িকী লেখে, “আসন্ন বিভক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন, তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিব। গত সপ্তাহে ঢাকায় ‘টাইম’-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে মুজিব বলেন, ‘পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনো আশা নেই’।”