বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অন্যতম অজানা শত্রু
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজও আমাদের একজন অন্যতম শত্রুকে আমরা চিন্হিত করতে পারলাম না। সবাই দেখি পাক-সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
এইগুলা তো আছেই, কিন্তু সেই সাথে আমরা ভুলে যাচ্ছি তত্কালীন সময়ে, আমাদের অন্যতম প্রধান শত্রুকে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন, কিন্তু আমার এই কথা বলার পিছনের অজানা যুক্তিগুলা পড়ে দেখুন:
১) ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা) ছিল পাকিস্তানের প্রধানতম মিত্র এবং যুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও বস্তুগত (অস্ত্র-গোলাবারুদ-সামরিক রসদ)- উভয়ভাবেই সহায়তা করে।
২) যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের কিছুই করার নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় আঁচ করতে পেরে নিক্সন ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়ন করেন, যা ভারতীয়রা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরু করার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে। এন্টারপ্রাইজ ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর গন্তব্যে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকির জবাব হিসেবে সোভিয়েত নৌবাহিনী ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী দু’টি ডুবোজাহাজ ভ্লাডিভস্টক থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে; যারা ইউএস টাস্ক ফোর্স ৭৪ কে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে তাড়া করে বেড়ায়।
৩) চীনের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্যে নিক্সন পাকিস্তানের জন্যে ইউএস কংগ্রেসের বরাদ্দকৃত বাজেট লঙ্ঘন করে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রেরণ করেন, পাশাপাশি চীনকেও পাকিস্তানে অস্ত্র-শস্ত্রের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে উৎসাহিত করেন।
৪) সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন প্রদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করে। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করবে। সোভিয়েত রাশিয়া ভারতকে আশ্বাস দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই আলোকেই ১৯৭১ এর আগস্টে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি সম্পাদিত হয়। আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত রাশিয়া এর জবাবে দু’টি সাবমেরিন পাঠায়।
৫) যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের উপদেষ্টা ছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হেনরী কিসিংগার। উনার নিজের ভাষ্যমতে: ২৫ শে মার্চ’ ১৯৭১ এর পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির খবর (অপারেশন সার্চলাইট) দশ দিন পূর্বেই সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ), পেন্টাগন এবং অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স সূত্রে রিচার্ড নিক্সন সরকার জানতে পেরেছিলেন। তবুও ওয়াশিংটন বাংলাদেশীদেরকে সতর্ক করেননি। ২৬ শে মার্চ’ ১৯৭১ এ হেনরী কিসিংগার একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেন, “রাষ্ট্রপতি নিক্সন এই বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলেন, তিনি একটি সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন করেন নাই”।
আরো অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:আর্চার ব্লাড। আর্চার ব্লাড পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তৎকালীন চলমান নৃশংসতা বন্ধে ব্যর্থ হওয়ায় কঠোর ভাষায় একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠানোর জন্য বিখ্যাত। তাঁর সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম বার্তা ব্লাড টেলিগ্রাম নামে পরিচিত।
৬) ২৫ শে মার্চের কাল রাতের পরে, সামরিক রসদে পরিপূর্ণ ১০ টি মার্কিন যুদ্ধ-জাহাজ পশ্চিম-পাকিস্থানে পাঠানো হয় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে। এইভাবে নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত আমেরিকা পশ্চিম-পাকিস্থানে একের পর এক সামরিক রসদ পাঠিয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় অস্ত্র রপ্তানি করার নীতি বর্জন করে। এইসব সম্ভব হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ও পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর মধ্যকার অতি-উত্তম সম্পর্কের কারণে।
এইভাবেই মার্কিনিদের পাঠানো সামরিক সাহায্য আর তাদের নিরবতার কারণেই আমরা ১৯৭১ এ নিষ্পেষিত হয়েছিলাম, সাথে ছিল পাক-সেনাদের বর্বতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মার্কিন-পাক কীর্তি আমরা ভুলতে বসেছি আজকে।
উপরের ৬ টি কারণের সাথে চাইলে আরোও অনেক কিছুই যোগ করা যায়, কিন্তু আর না। এইবার আসা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের বর্তমান সম্পর্কের আলোচনায়:
কইদিন আগে শুনলাম, ইউনুস সাহবকে নিয়ে ঝামেলায় জড়ানোর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন একজন নেতা (ব্লেক) বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশে মাটিতে দাঁড়িয়ে ১৬৫ মিলিয়ন বাংলাদেশীকে ঝারি দিয়ে গেছেন এই বলে যে, আমাদের সাথে নাকি উনাদের সম্পর্ক খারাপ হবে।
খুবই অবাক হলাম, এই রকম ঝারি শুনে। আমরা কেউ কিছুই বললাম না। নিজেদেরকে আজ পঙ্গু বলে মনে হচ্ছে
আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি: অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কুটনৈতিকভাবে। আমরা আজকে আমেরিকায় ছুটে চলেছি উন্নত জীবন, ভাল একটা চাকরি অথবা উচ্চতর শিক্ষার কারণে…….বিভিন্ন কারণে আমরা আজকে বলতে গেলে, তাদের কথায় উঠ-বস করি (শুনলাম তাদের কথামত নাকি আমাদের জাতীয় নির্বাচনের ভাগ্য নির্বাচিত হয়)…..আমরা আজ ভুলে গেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বন্ধু রাশিয়াকে……..
তবে আর কতদিন আমরা এইভাবে মার্কিন/পশ্চিমা আধিপত্যের কাছে মাথা-নত করে থাকব……নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় এসেছে আজকে…….সামরিক শক্তিতে না পারি, কিন্তু আমরা এগিয়ে যেতে পারি অর্থনীতি আর প্রযুক্তিতে……ইতিহাস বলে, আমরা স্প্যানিশ/পর্তুগিজ/ওলন্দাজ/ব্রিটিশ/পাকিস্থান সাম্রাজ্যকে হঠিয়েছি……..এইবার সময় এসেছে মার্কিন/পশ্চিমা সাম্রাজ্যকে পরাভূত করার………..আর এটা আমরা পারবই!
ভেবে দেখুন, এইত মাত্র ১৯৮৮ সালেও আমাদের জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের ৮৫% বিদেশী অনুদানের উপর নির্ভর ছিল……..আর সেই অনুপাত এখন কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২% এ……..এইভাবে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে পরিণত হতে পারব……ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, কে আমাদের প্রকৃত শত্রু আর মিত্র এইটা জেনে নিতে হবে……….তখন আর কোন পরাশক্তির কাছে আমরা আর মাথা নত করব না…….“কারো ঝারি খেয়ে মুতে দেবার সময় শেষ”
*** “পাক-সেনাবাহিনী, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্থান এবং সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার চাই”!
বিঃদ্রঃ আমার এই লেখাটা আসলে মার্কিন বিরোধী নয়, এইটা হল বাংলাদেশের জন্মের প্রকৃত ইতিহাস।
সবশেষে থাকল, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কোরবানী’ কবিতার একটা অংশ:
“ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন !
দুর্বল! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন !
ধ্বনি উঠে রণি’ দূর বাণীর, –
আজিকার এ খুন কোরবানীর !
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির সেরা আজি !- রহমান কি রুদ্র নন ?
ব্যাস ! চুপ খামোশ রোদন !
আজ শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে , শির দে বৎস” শোন !
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন !”