বাংলাদেশে মৎস্য উৎপাদন : পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া চাষের গুরুত্ব
মৎস্য আমাদের জাতীয় সম্পদ। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আবহমানকাল থেকেই অনুকূল পরিবেশে ও প্রাকৃতিক কারণে মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশের জীবন-জীবিকা নির্বাহে মৎস্য খাতের ওপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে এ সম্ভাবনাময় সেক্টরের ভূমিকা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১২-১৩ সালে মাছের মোট উপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪.১০ লাখ মেট্রিক টনে, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির ক্রমধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২০-২১ সালের মধ্যে উৎপাদন ৪৫.৫২ লাখ মেট্রিক টন অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। দেশের রপ্তানি আয়ের ২ শতাংশের অধিক আসে মৎস্য খাত থেকে। বাংলাদেশ বর্তমানে মৎস্য চাষে বিশ্বে পঞ্চম স্থান দখল করেছে।
উল্লেখ্য, জাতীয় মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ আসে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া থেকে। আশির দশকের শেষের দিকে আমাদের দেশে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া চাষ শুরু হয়। বাণিজ্যিক মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ প্রজাতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আমাদের দেশের আবহাওয়া বিশেষ করে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কারণ পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া দ্রুত বর্ধনশীল (৩-৫ মাসে আহরণ করা যায়), অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, অধিক ও নি¤œ তাপমাত্রার পার্থক্য সহনশীল, কম গভীরতায় ও সব ধরনের জলাশয়ে চাষ করা যায়, মোটামুটি নি¤œমানের পরিবেশে বাঁচতে পারে, মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা সহনশীল (০-১০ পিপিটি, শেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে), কম মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেনে ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি, কম তাপমাত্রায় ও বৃদ্ধি ভালো, খুব কম জায়গায় অধিক পরিমাণ চাষ করা যায়, এদের পোনা প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়, তাদের উৎপাদন শতাংশ প্রতি খুবই ভালো।
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার প্রায় ৬৩ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় মাছ। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক গরিব তাই তারা এ চাহিদা মেটানোর জন্য অন্যান্য মাছ তেমন কিনতে পারে না। পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া সহজে চাষযোগ্য হওয়ায় এবং উচ্চশীল ফলনের জন্য এদেশে এরা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এসব মাছ চাষের জন্য তেমন আলাদা খাবারের প্রয়োজন হয় না, প্রতিদিন আমাদের খাবারের পর যে অবশিষ্ট অংশ থাকে তা এ প্রজাতি মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই বাজার থেকে আলাদা খাবার না কিনলেও চলে। পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া যে কোনো ধরনের পরিবেশ যেমন পচা ডোবানালা, ছোট পুকুর, নর্দমা ও অন্যান্য জলাশয়ে ও চাষ করা যায়, যা অন্য প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রে চাষ করা যায় না। আমাদের দেশে বিদ্যমান স্বাদুপানি ও লোনাপানি বা উপকূলীয় জলাশয়ে উন্নত জাতের পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া চাষাবাদ বিস্তার লাভ করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এসব প্রজাতির মাছ সাধারণত একক বা মিশ্র চাষ করা যায়। পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে নানা শ্রেণির মানুষ। বাজারে এ দুটি প্রজাতির চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশের লোকেরা যদি আরও বিস্তারভাবে এসব প্রজাতির মাছ চাষ শুরু করে, তা হলে তাদের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা খুব অনায়াসে মিটবে এবং আর্থিকভাবে তারা স্বাবলম্বী হবে এবং তখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। ফলে আমাদের দেশ আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে নজর দিলে দৃশ্যমান হয় যে ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ড নিজ দেশের গ-ি পেরিয়ে এ প্রজাতি দুটি অতি সহজেই বিদেশের বাজার দখলে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করলে আমাদের দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে এ প্রজাতি দুটি অতি সহজেই বিদেশের বাজার দখলে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হব। তাই পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের ওপর আমাদের দেশের একদল গবেষক নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এবং তারা অনেক ফলাফলও পেয়েছেন। দেশের মৎস্য চাষিদের অর্থনৈতিক বিষয়, ক্রমবর্ধমান নিরাপদ আমিষের গুরুত্ব এবং কীভাবে ভবিষ্যতে আরও বাজার মূল্য বাড়ানো যায় এবং সবার কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করা যায়, তা বিবেচনা করে সম্প্রতি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক (Upgrading Value Chains of Pangas and Tilapia in Bangladesh) শিরোনামে এক গবেষণার কাজ হাতে নিয়েছেন। উল্লিখিত গবেষণাটি আগামীতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের অবদান তথা খাদ্য নিরাপত্তা, বাজার মূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের কাছে আরও জনপ্রিয়তা লাভ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।