বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম

বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তি এক ও অভিন্ন

একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশের হাল ধরেন, তখন তার একান্ত সচিব ছিলেন
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আর্থসামাজিক মুক্তিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নরের স্মৃতিচারণায়।
আগস্ট নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
আগস্টের অনুভূতি অঝোরে কাঁদায়; গভীর শোকে আচ্ছন্ন থাকি। এ মাসে বেদনাময় একটা নীল সারা দেহমন ও হৃদয়ের অনুভূতিকে সিক্ত করে দেয়। ১৫ আগস্ট ভোরের আলো দিগন্তকে উদ্ভাসিত করার আগেই ঘটে ইতিহাসের এক বর্বরতম নৃশংসতার ঘটনা। সপরিবারে হত্যা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। শেখ হাসিনার কারণেই এখন বিশ্ববাসীর নজরকাড়া আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির গৌরব অর্জন করে চলেছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে সূত্রপাত এটা কি তার শৈশব থেকেই হয়েছিল?
অবশ্যই। রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেখড়ি তার শৈশবে মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা নদীর কিনারে গ্রামবাংলার মাঠে-ময়দানে। তিনি খুব দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্রমনা ছিলেন। অনেক বড় বড় নেতা অপপ্রচার করেন যে, তিনি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন। কিন্তু তা নয়। তার পূর্বপুুরুষ আরব দেশ থেকে এসেছিলেন। নইলে তাদের এত দশাসই চেহারা হয় কী করে। আমি টুঙ্গিপাড়ায় অনেকবার গিয়েছি তার সঙ্গে। দেখেছি তারা খুব বড় জোতদার, বড় ভূস্বামী ছিলেন। তাদের বাড়িতে হরহামেশাই মেহমান হতো। তিনি গ্রামগঞ্জ দেখেছেন দুঃখী মানুষের কাছ থেকে। শৈশবে তিনি স্বেচ্ছায় দুঃখী মানুষদের সাহায্য করতেন, নিজের জিনিস অন্যের প্রয়োজনে বিলিয়ে দিতেন। দুটো জিনিস তার মনমানসিকতায় অর্থনীতি সম্পর্কে রেখাপাত করে। প্রথমত, তিনি দেখেছিলেন দারিদ্র্যের কদর্য কশাঘাতে মানুষ কীভাবে দুর্দশার চরমে পৌঁছে সর্বস্বান্ত হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি উপলব্ধি করেন যে, পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুন পরম মমতায় গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়াতেন, অন্ন-বস্ত্রের সাহায্যে হাত প্রসারিত করতেন। তাই তো বস্ত্রহীন পথচারীকে গায়ের জামা খুলে দিয়েছেন। পারিবারিক গোলা থেকে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত গরিব-দুঃখীকে পিতার অনুপস্থিতিতে ধান বিতরণ করেছেন। পরে পিতার সস্নেহ অনুমোদন পেতেও কষ্ট হয়নি। ঘটনাবহুল দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদে বাধাবিপত্তির জাল ছিন্ন করেছেন তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করতেন। দুঃখী বাঙালির অন্ন-বস্ত্র, আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের কৃতসংকল্প ভাবনাই দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন শেখ মুজিব। শহর-বন্দর, নগর ছাপিয়ে গ্রামবাংলার কোটি মানুষ বাঁশের লাঠি সজ্জিত হয়ে খানসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করতে রাস্তায় নেমে পড়েন। কারণ তাদের প্রাণের নেতা ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার। পৃথিবীর ইতিহাসে নেতার নির্দেশে এভাবে স্বাধীনতার লড়াই করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির নেই। শহীদের রক্তগঙ্গায় বহু সাগর পেরিয়ে বহুমূল্যে এসেছে আমাদের  স্বাধীনতা।
বাকশাল নিয়ে নানা কথা শোনা যায়, আপনার মতামত কী?
এটা খুব বড় উদ্যোগ ছিল। সম্ভবত এটা জাতির পিতার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্মকা- হতে পারত। তার প্রেক্ষাপটটা এরকমÑ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার জন্য। সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু দেখতে পেলেন যে, বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর যে সমস্ত উদ্যোগ বিশেষ করে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিকল্পিত পরিকল্পনা খাতে; প্রয়োজনবোধে বিত্তবানদের ওপর বেশি ট্যাক্স ধার্য করে সেটা দিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য, দুঃখী মানুষের জন্য হাসপাতাল গড়া, স্কুল করা, রাস্তাঘাট বানানো এ সমস্ত খুব ফলপ্রসূ হচ্ছিল। এমনকি ১৯৭৪-৭৫ সালে বার্ষিক সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি, সম্ভবত ৪.৫-৫ ভাগ হয়েছিল। কিন্তু যতটা দ্রুতগতির প্রত্যাশা ছিল মানুষের, সেটা অর্জিত হচ্ছিল না। এটা হচ্ছে এক নম্বর। দুই হচ্ছে, ১৯৭৩ সালে ১ জানুয়ারি জাসদ একটি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন প্রকৃতভাবেই অনেক নেতিবাচক কর্মকা- ঘটে। থানা আক্রমণ হয়, নির্বাচিত এমপিকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে এবং লুটতরাজের মতো পরিবেশ তৈরি হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে। তাতে উনার নিজের দলের মধ্যেও চুরির ঘটনা ঘটে, তাতে তিনি খুব ব্যথিত হন। তাই প্রথমে তিনি চেষ্টা করেছিলেন সেনাবাহিনী দিয়ে এগুলো ঠিক করা যায় কিনা, স্মাগলিং বন্ধ করা যায় কিনা। তাতে কতগুলো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় উনার দলীয় লোকজনের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ হয়, মারামারি হয়। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। সেজন্য তিনি মনে করলেন এটাই সম্ভবত স্বাধীনতার পর-পরই হওয়া উচিত ছিল এবং তিনি যদি সাড়ে নয় মাস অনুপস্থিত না থাকতেন অথবা যদি কোনো সুপরামর্শ শুরুতেই পেতেন তা হলে একেবারে শুরুর দিকেই জাতীয় একটা সরকার করে ফেলতেন। আর বাকশালের প্রোগ্রামটা করতেন। বাকশাল প্রোগ্রামের তিনটা ভাগÑ একটা হলো রাজনৈতিক। তিনি একদমই মনে করতেন না একদলীয় শাসন। এটা উনার সহজ-সরল চিন্তাধারা ছিল। তিনি মনে করতেন, আমি তো জাতির পিতা, আমি সবাইকে একজায়গায় করেছি, একের মধ্যে বহু সম্মিলন করেছি, এটা রাজনৈতিক দিক। আমি এ ব্যাপারে জানিও না, বুঝিও না। কিন্তু অন্য যে দুটো দিক প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক। এগুলো সুদূরপ্রসারী। কীভাবে সুদূরপ্রসারী? প্রশাসনিকটা আগে বলে নিইÑ ঢাকা থেকে আট কোটি বা সাড়ে আট কোটি বা বর্তমানে সাড়ে ষোলো কোটি মানুষকে যে প্রশাসনিক সেবা দেয় এটা বেশ কঠিন, সম্ভব নয়। কাজেই স্থানীয় পর্যায়ে সরকার ব্যবস্থাপনা তৈরি করার তাগাদা বোধ করছিলেন। এজন্য প্রথমত তার দল আওয়ামী লীগের ৬৩টি জেলা মহকুমা ছিল, পরে জেলা করে আর একটি যোগ হয়। একজন করে জেলার নিয়োগ দেন। প্রশাসনিকভাবে প্রত্যেকটা জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ দেন দুবছরের জন্য। কথা ছিল দুই বছর পর পর গভর্নর নির্বাচিত করা হবে এবং ওই গভর্নরই সংশ্লিষ্ট জেলার সমস্ত কর্মকা- পরিচালনা করবেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের সহায়তা করবেন। সে অনুযায়ী ১ আগস্ট প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৫ আগস্ট প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৭ আগস্ট তাদের কার্যভার বুঝে নেওয়ার কথা। এটার ফল যে কত বড় হতে পারত এবং এটার প্রয়োজনীয়তা যে কত বড় ছিল এটা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। আর একটা ভাগ হলো অর্থনীতি। এ ক্ষেত্রে উনার কথাটা ছিলÑ আমাদের ছোট ছোট ভূখ-ের মাঝে অনেক আইল থাকে। এগুলো সব এক জায়গায় করে সমবায় ব্যবস্থা করা। তিনি মনে করতেন, বাধ্যতামূলক সমবায় করা যাবে। সমস্ত জমিকে একজায়গায় করে আধুনিক উপায়ে চাষাবাদ করে ফলন তিনগুণ করে কৃষাণ-কৃষাণীকে আগের তুলনায় দুই গুণ দিয়ে একভাগ সরকারের জন্য রাখা। এটা ছিল তার উদ্দেশ্য। এটা করে ফেলতে পারলে বাংলাদেশ যে কোথায় চলে যেত এতদিনে! কিন্তু জমি একীভূত করার সিদ্ধান্তে একটা অপপ্রচার হলো যে, শেখ মুজিব তোমাদের সব জমি নিয়ে যাচ্ছে। যাদের খুব কম থাকে, তারা নিজস্ব সম্পত্তি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। এ জন্য অনেক ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ায় ওটা আর করা যায়নি। আর প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা বিকেন্দ্রিক করতে পারলে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হওয়ার মহাগতি থেকে থামানো যেত না। এ জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি প্রচ-ভাবে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। জাতীয়তাবাদী নেতাকে আন্তর্জাতিকভাবে বড় বড় প্রতিবেশী কেউ পছন্দ করেন না। তিনি প্রচ-ভাবে জাতীয়তাবাদী ছিলেন। শুধু জনকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। সেজন্য তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানত একাত্তরের পরাজিত শত্রু এবং তাদের যারা প্রভু তারা উদ্যোগ নেয়। তারা সেনাবাহিনীতে, বিভিন্ন জায়গায় অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের সাথে বিভিন্ন দেশের (নাম বলা হয়তো কঠিন হবে, ভয়ও লাগবে) আগ্রহ যুক্ত হয় তাকে হত্যার। এটাই কিন্তু ১৫ আগস্টের যে শোকাবহ, যে নৃশংসতম হত্যাকা-, বঙ্গবন্ধুর যে শাহাদাত বরণ,  তার পটভূমি।
তা হলে কি বাকশালের কারণেই শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, বাকশাল একের মধ্যে বহুর সম্মিলন। যা-ই হোক, সেটি তার চিন্তাভাবনার বিষয়। সেটি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এমএজি ওসমানী ও নূরে আলম সিদ্দিকীÑ এ চারজন সংসদে বসে এই কথিত একদলীয় শাসনের আইনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও ভোট দিয়েছিলেন। তাদের কিন্তু কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের প্রতি কোনো সময় রক্তচক্ষু দেখাননি বঙ্গবন্ধু। বাকশালের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত জাতিকে একীভূত করতে। পুরো জাতি যেন একযোগে কাজ করে। হ্যাঁ এটাতে শত্রুতা হয়েছে, যারা ক্ষমতায় যেতে চান তাদের সঙ্গে। কারন তাদের অসুবিধা হবে। একটা জিনিস বলতে চাই, বাকশালে তিনি সাত সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করেছিলেন। তার একমাত্র সদস্য শেখ আবদুল আজিজ এখনও বেঁচে আছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম লোক ছিলেন। তার মতোই দশাসই চেহারার লোক তিনি সাত নম্বর সদস্য ছিলেন। খুলনায় তার বাড়ি। নির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য যে কত বড় বড় লোক লাইন দিয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেননি। তাদের সন্তানসন্ততি যারা এখন বেঁচে আছে, তারা এই বাকশালের সমালোচনা করে। যে সমস্ত সম্পাদক এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, যারা নির্বাহী কমিটিতে ঢোকার চেষ্টা করেছেন, বাকশালে ছিলেন তাদের পক্ষ থেকেই জোরেশোরে সমালোচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল সফল হলে সমালোচনাটা তখন সময়ের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে বিজয় বলে আলোচিত হতো। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে একটি সহনশীলতা ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও মহানুভব। দয়া, ক্ষমা, মহত্ত্ব¡ শব্দগুলো তার সঙ্গে জুতসই। তার উদারতার সুযোগ পেয়েই যড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাকশালের কারণেই কি শোকাবহ আগস্ট?
একমাত্র বাকশালই নয়। আমি মনে করি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্নÑ সে স্বপ্ন নস্যাৎ করতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। বাকশাল তো একটা নিমিত্ত মাত্র। বাকশালের মাধ্যমে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্রটা তাদের হাতে তার রসদ এসে যায়। বাকশাল কিন্তু মূল কারণ নয়। মূল কারণ হলো বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সফলভাবে গড়ে তোলা এবং সমাজতন্ত্র করে ফেলতে সক্ষম হওয়া। বাকশাল চীনা সমাজতন্ত্র নয়, বাংলাদেশি ধাঁচের সমাজতন্ত্র। কেন, বলি এটা। অন্যান্য সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের হাতে মিনস অব প্রডাকশন থাকে কিন্তু শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রে তিনটি সিমের সম্পদের মালিকানা ছিলÑ রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত। তার এই আদর্শকে মেরে ফেলার জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। এই দেশকে ইসলামিক রিপাবলিক করার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশ বেতারের নাম হয় রেডিও বাংলাদেশ। কিন্তু এগুলো শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আমাদের যে প্রাক্তন প্রভুরা, যারা আমাদের বঞ্চিত করেছিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের ধাঁচে এসব করেছিলেন। আসল কারণ হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মেরে ফেলা। কেননা বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক এজেন্ডা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। ঐ যে ৭ মার্চ তিনি বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ঐ মুক্তি কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি।
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও অর্থনৈতিক মুক্তি এ বিষয়ে আপনার মত কী?
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিতভাবেই এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের  মহানায়ক হিসেবে আবির্ভাব এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক মুক্তির কথা বলতেই হয়। অতীতে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার সমৃদ্ধি সর্বজনবিদিত ছিল। চীন পর্যটকরা, ইবনে বতুতা প্রমুখ এটি প্রত্যক্ষ করেন এবং তাদের ভ্রমণ কাহিনিতে এর উল্লেখ করেন। মার্কেন্টিলিস্ট বহির্বাণিজ্য মাধ্যমে রাতারাতি ধনসম্পদ, বৈদেশিক মুদ্রা ও মূল্যবান হীরা-জহরত (কোহিনূর মণিসহ), সোনাদানা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে ইউরোপীয় শক্তিসমূহ সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলার দিকে লোলুপ দৃষ্টি ফেলে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্বুদ্ধিতা ও স্যার টমাস রো কর্তৃক অভিনীত ছলচাতুরীর ফলে ধূর্ত ইংরেজগণ ভারতবর্ষে আপাতদৃষ্টিতে ‘নির্দোষ’ বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। আর এগুলোই হয়ে ওঠে একশ নব্বই বছরের শোষণ ও লুণ্ঠনের ছাড়পত্র। ২৩ জুন ১৭৫৭ তারিখে মীর মদন, মোহন লালের অসাধারণ শৌর্য-বীর্য এবং আত্মত্যাগ সত্ত্বেও মীরজাফরীয় বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল বেনিয়া ইংরেজদের কাছে। তার পর ড্যান্ডিতে তৈরি কাপড় আমাদের মসলিনের কাছে প্রতিযোগিতায় অক্ষম হওয়াতে মসলিন বস্ত্রবয়ন শিল্পীদের হাত কাটা ও নীলচাষিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচারে সোনার বাংলা শ্মশান হয়ে গেল। পূর্ববাংলা তখন ব্যবহৃত হচ্ছিল পশ্চাৎভূমি হিসেবে; এখানকার অধিবাসীরা শোষিত হতে হতে অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যান। অবস্থা পরিবর্তনে বঙ্গভঙ্গ হলো ১৯০৫ সালে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য বঙ্গবন্ধু কী পরিকল্পনা করেছিলেন?
বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনৈতিক সাধনা ছিল জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। তার কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনার মধ্যে বিষয়টি গভীর ও বিপুলভাবে সন্নিবেশিত ছিল। তার ধ্যানধারণার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নিম্নবিত্ত মানুষ, কৃষাণ-কৃষাণী ও শ্রমজীবী। তার কল্পনায়, তার চিন্তায়, তার রাজনীতিতে, তার দর্শনে সদা দীপ্তমান ছিল অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা ও ঐশ্বর্যের চিন্তাভাবনা। দেশ স্বাধীনের আগে যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল, এগুলোর প্রতিটিই অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে। যেমন ছয় দফা আন্দোলন। সেখানেও অর্থনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কীভাবে দুই অর্থনীতি চলবে এক দেশে। কীভাবে স্বাধীনভাবে বাণিজ্য হবে? কীভাবে আলাদাভাবে মুদ্রাব্যবস্থা পরিচালনা করা যাবে? স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেখানেও অর্থনৈতিক বিবেচনা ছিল মুখ্য। অর্থনৈতিক সংস্কারের অধীন তিন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুÑ স্বল্পকালীন, মধ্যবর্তী ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে বলুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় কেনাকেটায় দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এমনকি পচাত্তর সালে বর্বরতম পৈশাচিক হত্যাকা-ের পরও মোশতাক সরকার যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার জন্য তদন্ত করেছিল, সেখানেও তার ও তার পরিবারের কোনো দুর্নীতির লেশমাত্র পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় বিষয়, ’৭৪-৭৫ সালের যে অর্থনীতি, তাতে দেখা যায়, সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যে। যেটি আমরা এতদিন পর ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে অর্জন করতে পেরেছি। অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ জাতির পিতার নির্দেশিত পথ ধরে। সব পরিসংখ্যানই তা বলে। বঙ্গবন্ধুর মূলমন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিকভাবে আমরা অনেক এগিয়েছি। যত দিন যাচ্ছে, ততই স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ভরসাতেই, তার নেতৃত্বগুণেই একাত্তরে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। তার দেখানো পথেই বাংলাদেশ সারা বিশ্বে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
সোনার বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে বলুন।
জাতির জনক অবশ্যই বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনামুক্ত সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘমেয়াদি আমূল সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল আঞ্চলিক সহযোগিতা। তার ধারণা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি সম্মিলিতভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়, তা হলে তার শক্তি হবে দুর্বার। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থানে চলে যেতে পারবে। বাংলাদেশে পানির সমস্যা নিয়ে জাতির জনক সব সময় চিন্তিত ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগেই তিনি জাপানিদের সঙ্গে কথা বলে হওয়াকাওয়া কমিটি গঠন করে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। প্রতিবেশী ভারত আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। সে কথা স্মরণ রেখেও বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা নির্ধারণ, গঙ্গার পানিবণ্টন, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাবর্তন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থকে সামগ্রিকভাবে সমুন্নত রেখে আলোচনা ও চুক্তি করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে পৈশাচিকভাবে হত্যার বিচার নিয়ে বলুন।
স্বাধীনতার আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দারিদ্র্য, অপুষ্টি, শোষণ, বঞ্চনা ও  বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়ার রূপকার ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করে সেই আদর্শ এবং জাতিকে যারা নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল, তার বিচারই বা কোন সাহসে কে শুরু করতে পারতেন? বিচারে হন্তারকরা ক্রমে ক্রমে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলছে। জাতি আশা করছে, সেই হন্তারকদের দায়মুক্তি দিয়ে করা অধ্যাদেশ এবং পরবর্তী সময় সংসদে সেই দায়মুক্তিকে আইনি বৈধতা যে দুজন দিয়েছিলেন, তাদেরও মরণোত্তর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
আজকের দিনে আমাদের কী শপথ নেওয়া উচিত?
প্রতিবছর আগস্ট এলেই শোকের মাতম হয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথের প্রতিযোগিতা হয়। বিশিষ্টজন, বিত্তবান, নীতিনির্ধারক, নীতি সমালোচক, বুদ্ধিজীবী ও প-িত এবং রাষ্ট্র ও সমাজপতিরা যদি প্রতিদিন ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার’ ইস্পাতকঠিন শপথ বাক্যটি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখাবয়ব স্মরণ করি, তা হলে অনেক অন্যায়, অপচয়, শোষণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি হ্রাস পেত নিঃসন্দেহে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *