বাংলাদেশ সবচেয়ে ‘আশাবাদী দেশ’ অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় ‘দ্বিতীয়’
রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা অর্থনৈতিক দুর্দশাÑ শত ঝড়ঝঞ্ঝায়ও মানুষ আশাহত হয় না, বরং সব সময় আশাবাদী। আর এ আশাবাদ বিবেচনায় বিশ্বের সব দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। এমনকি অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রত্যাশায়ও বাংলাদেশের মানুষ অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এ বিবেচনায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইন ও গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ আশাবাদী দেশ এবং শীর্ষ ১০ হতাশ দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে সবাইকে চমকে দিয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। আশাবাদ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সুখ এই ৩টি আলাদা সূচকের ওপর পরিচালিত হয় এই জরিপ। আগামী বছরটি বাংলাদেশের জন্য আরও ভালো যাবে, না খারাপ হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে দেশের ৮১ শতাংশ মানুষ জানায়, আগামী বছরটি আরও ভালো যাবে। ৭ শতাংশ মানুষ নতুন বছর নিয়ে হতাশ। ১১ শতাংশ মানুষ মনে করছে, বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না এবং ২ শতাংশ মানুষ কোনো মন্তব্য দেয়নি। সব মিলিয়ে এদেশের ৭৪ শতাংশ মানুষই আশাবাদী ২০১৬ সাল তাদের জন্য সম্ভাবনা বয়ে আনবে। এই জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে আশাবাদী ১০ দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আগামী বছরটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সম্ভাবনাময় হবে, না আরও কঠিন হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ৭২ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক আশাবাদের কথা জানায়। ১২ শতাংশ মানুষ নতুন বছরের অর্থনীতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। ১৪ শতাংশ মানুষ জানায়, এ বছর কোনো পরিবর্তন আসবে না। ২ শতাংশ মানুষ কোনো উত্তর দেয়নি। সব মিলিয়ে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষই নতুন বছরের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী।
অন্যদিকে সুখ সূচকে প্রশ্ন করা হয় বর্তমান জীবন নিয়ে মানুষ সুখী কি না। এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ জানায় তারা সুখী। ২৮ শতাংশ মানুষ সুখী কিংবা অসুখী কোনোটিই মনে করছে না। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ বর্তমান জীবন নিয়ে অসুখী। ২ শতাংশ মানুষ কোনো উত্তর দেয়নি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ৬২ মানুষ নিজেদের সুখী হিসেবে মনে করছে। বিশ্বের ৬৮ দেশের ৬৬ হাজার ৪০ মানুষের ওপর জরিপটি চালিয়েছে গ্যালাপ। অংশগ্রহণকারী প্রতি দেশের প্রায় ১ হাজার মানুষ এ সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর সময়ে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বছরের শুরুতেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এটি গ্যালপের ৩৯তম বার্ষিক জরিপ। জরিপে আশাবাদ সূচকে বাংলাদেশের পরের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের ৭০ শতাংশ মানুষ নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী, তৃতীয় স্থানে থাকা নাইজেরিয়ার ৬৮ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, চতুর্থ স্থানে থাকা ফিজির ৬১ শতাংশ মানুষ আশাবাদী নতুন বছর নিয়ে। পঞ্চম স্থানে থাকা মরক্কোর ৫৭ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, ষষ্ঠ স্থানে থাকা সৌদি আরবের ৫৬ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, সপ্তম অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামের ৫৫ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, অষ্টম স্থানে থাকা আর্জেন্টিনার ৫৩ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, নবম স্থানে থাকা ভারতের ৪৭ শতাংশ মানুষ আশাবাদী এবং পাকিস্তানের ৪২ শতাংশ মানুষ নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী। অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশাবাদে প্রথম স্থানে রয়েছে নাইজেরিয়া। এদেশের ৬১ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে থাকা চীনের ৫৪ শতাংশ মানুষ নতুন বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে আশাবাদী, চতুর্থ স্থানে থাকা ভিয়েতনামের ৫৩ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, পঞ্চম হওয়া পাকিস্তানের ৫০ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, ষষ্ঠ স্থানে থাকা ভারতের ৪৪ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, সপ্তম হওয়া মরক্কোর ৪৪ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, অষ্টম স্থানে থাকা ফিজির ৩৯ শতাংশ মানুষ আশাবাদী, নবম স্থানে থাকা সৌদি আরবের ৩২ শতাংশ এবং দশম হওয়া আর্জেন্টিনার ২৮ শতাংশ মানুষ নতুন বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদী।
৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করে অর্থনীতি সঠিক পথে
দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করে বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। তাদের মতে, গণতন্ত্রের চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি বেশি প্রয়োজনীয়। ৭৯ শতাংশ মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট। আর ৫৯ শতাংশ মানুষ বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বলে মনে করে। মার্কেটিং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিয়েলসেন-বাংলাদেশের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি তত্ত্বাবধান করেছে গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারস ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আইআরআই বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংগঠনের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে নানা ধরনের জরিপ ও গবেষণা করে থাকে।
গত বছরের ৩০ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বশেষ জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে বহু স্তরে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। দেশের সাত বিভাগে জেলা অনুযায়ী এবং গ্রাম ও শহরে ব্যক্তি পর্যায়ে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। জরিপে অংশ নেন ২ হাজার ৫৫০ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপের ফল প্রকাশের কথা রয়েছে।
জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে নাকি ভুল পথে?’ জবাবে উত্তরদাতাদের ৬৪ শতাংশ বলেছেন, বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে। ৩২ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, দেশ ভুল পথে আছে। ২০১৩ সালে একই সময় ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করত দেশ ভুল পথে যাচ্ছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই মনে করেন যে বাংলাদেশ সঠিক নির্দেশনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। ৬৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, অর্থনীতিসহ শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম শক্তি। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মনে করেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
আগামী বছর আপনার বা আপনার পরিবারের ব্যক্তিগত আর্থিক উন্নতি হবে। খারাপ হবে নাকি একই রকম থাকবে? এর উত্তরে ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, উন্নত হবে। ১০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, একই রকম থাকবে। আর ৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, খারাপ হবে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৮ শতাংশ মনে করেন, আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখা যায়। এক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ উত্তরদাতার আস্থা বিএনপির ওপর।
জিএসএল সূচকে চার ধাপ অগ্রগতি বাংলাদেশের
তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্ভাবনা বাড়ল
ক্রমেই বৈশ্বিক বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। আউটসোর্সিং, ব্যাক অফিস বা অফশোরিং, বিজনেস প্রসেসিং আউটসোর্সিং (বিপিও), ভয়েস সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে গ্লোবাল সার্ভিসেস লোকেশন ইনডেক্সে (জিএসএলআই) চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে জিএসএলআই ইনডেক্সে ২৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম। তালিকায় বাংলাদেশ ২২তম অবস্থানে থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসা সংশ্লিষ্ট খরচ সাশ্রয়ের দিকে থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান এটি কারনি প্রকাশিত এক জরিপে বাংলাদেশ এই সম্মানজনক অবস্থান পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে এই সূচক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে সফটওয়্যার ও আইটি সেবাপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের এই অর্জন। এতে বিশ্বের শীর্ষ ৫৫ দেশের মধ্যে ৬.৯৬ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে ভারত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন (৬.৪৯) ও মালয়েশিয়া (৬.৫)। এটি কারনির জরিপে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫.৩১ পয়েন্ট।
তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যয় সাশ্রয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ৩.৩৪ পয়েন্ট পেয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করেছে। তালিকায় বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, চেক রিপাবলিক, লিথুয়ানিয়া, পাকিস্তানের মতো দেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আইটি ও বিপিও সেবার মাধ্যমে। তবে বেশির ভাগ কোম্পানিই দেশীয়। যেমন বাংলাদেশি কোম্পানি গ্রাফিকপিপল বহির্বিশ্বের কোম্পানিগুলোকে গ্রাফিক ডিজাইন সেবা সরবরাহ করে। তবে বাংলাদেশে এখনও আউটসোর্সিং ছোট হলেও অনলাইন মার্কেট প্লেস ওডেস্কের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্স কাজের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষিত, পরিশ্রমী ও দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল তরুণ জনশক্তি থাকায় আউটসোর্সিংয়ে এদেশের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আর্থিক সাশ্রয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেও দক্ষ জনশক্তি ও বাণিজ্যিক পরিবেশের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
কৃষিতে ভরসার ইঙ্গিত দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। এই অঞ্চলে গত চার বছরে ধানের উৎপাদন ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ ও আলু উৎপাদন। এর মাধ্যমে আবার কৃষির ভরসা হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল।
কৃষি ও খাদ্যনীতি-বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই চিত্র পাওয়া গেছে।
লবণাক্ততার কারণে আগে দক্ষিণের জেলাগুলোয় বছরে একবার বোরো ধান চাষ হতো। বাকি সময় জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলে ঘের করে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। কিন্তু চিংড়ি চাষে লোকসান, ধান উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা বিকল্প হিসেবে ভুট্টা, ডাল, তেল জাতীয় শস্য ও আলুর মতো পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এটা কেবল দক্ষিণাঞ্চল নয়, পুরো দেশের খাদ্য ব্যবস্থার জন্য এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
ইফপ্রি’র ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গত চার বছরে ধানের দাম না বেড়ে উল্টো ৬ শতাংশের মতো কমেছে। এতে হতাশ কৃষক ৩ দশমিক ৬ শতাংশ জমিতে ধানের চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এতে ধানের উৎপাদন কমেনি, বরং ২ শতাংশ বেড়েছে। আর আমন ধানের চাষ বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।
একই সাথে গত চার বছরে দক্ষিণাঞ্চলের ২০টি জেলায় ভুট্টার উৎপাদন এলাকা ৩৮০ শতাংশ, ডাল ৩০ শতাংশ, তেল জাতীয় শস্য ৩৫ শতাংশ ও আলুর উৎপাদন এলাকা ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি মাছের ঘেরের পাশে সবজি চাষ করার প্রবণতাও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে ব্যাপক হারে বাড়ছে।
দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মেহেরপুর, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা ও ফরিদপুরে কৃষির পরিবর্তন নিয়ে জরিপ চালায় ইফপ্রি।
এ ছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, নড়াইল ও মাগুরা জেলায় চিংড়ি ও মাছ চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ বাড়তে দেখা গেছে। বিশেষ করে সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী, মুগ ও মসুর ডাল এবং মাছের ঘের ও পুকুরপাড়ে সবজির আবাদ সহজেই নজর কাড়ছে।
ওই ৬টি জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে ফসল চাষের দিকে তারা ঝুঁকছেন ভালো দাম পাওয়ার কারণে। সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। তাতে বলা হয়, লবণাক্ততা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ৫০ শতাংশ জমিতে বছরে মাত্র একটি ফসল হয়। আর মাত্র ৪৬ শতাংশ জমিতে হয় দুটি ফসল। দেশের কৃষিজমিতে বছরে গড় শস্যাবর্তনের হার ১৭৬ শতাংশ। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের শস্যাবর্তনের হার ১৫৯ শতাংশ। আর ওই এলাকার ১৫ শতাংশ জমিতে কোনো ফসলই হয় না।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় তৈরি করা ওই মহাপরিকল্পনা দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী ফসলের জাত হিসেবে ডাল ও তেল জাতীয় ফসলের চাষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডাল ও তেল জাতীয় শস্যে এখনও বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, আমরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে মোট ৫টি প্রকল্প পরিচালনা করছি। ব্রি’র উদ্ভাবিত জাতগুলো আরও জনপ্রিয় করতে আমরা সামনে কিছু উদ্যোগ নেব। আমাদের মূল লক্ষ্য ওই এলাকায় পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন সংস্থার (এসআরডিআই) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট উচ্চ লবণাক্ত এলাকা। বাকি জেলাগুলোতে মাঝারি ও স্বল্প লবণাক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে সেচের পানির অভাব ও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর বেশির ভাগ জমিতে বর্ষার তিন মাস ছাড়া বাকি সময় চাষ করা যেত না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) গত চার বছরে মোট ২০টি নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যার অর্ধেকই দক্ষিণাঞ্চলের উপযোগী লবণাক্ততা, খরা ও ঠা-া সহিষ্ণু জাত। কৃষক পর্যায়ে ওই জাতগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
ব্রি’র মহাপরিচালক জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী আরও কিছু জাত নিয়ে আমরা কাজ করছি। নতুন জাতগুলো কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে আমরা বেসরকারি সংস্থাগুলোরও সহযোগিতা পাচ্ছি।
ইফপ্রি’র ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক কিছুটা হতাশ ছিলেন। তবে তারা বসে থাকেননি। ধান চাষের ক্ষেত্রে জাত নির্বাচনে কৃষক যৌক্তিক ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক সবচেয়ে বেশি চাষ করতেন বাণিজ্যিক সেচনির্ভর বোরো ধান। কিন্তু এই চার বছরে ধানের দাম ৩ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। কৃষি-মজুরি বেড়েছে ২৪ শতাংশ। সেচের খরচ বেড়েছে ৯ শতাংশ। ফলে বোরো ধান বিক্রি করে কৃষকের মুনাফা কমে গেছে। চার বছর আগে যেখানে মোট চাষের জমির ৩১ শতাংশে বোরো ধানের চাষ হতো, ২০১৫-তে তা ২৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে কৃষক বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান চাষের দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। বিশেষ করে দেশি জাতের আমন ধান চাষ ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। চার বছর আগে মোট চাষের জমির ২ দশমিক ২ শতাংশ ছিল আমন। ২০১৫-তে এসে তা ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বোরোর তুলনায় আমনে খরচ ৩৮ শতাংশ কম। উৎপাদনও অবশ্য কম হয়। ইফপ্রি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আখতার আহমেদ বলেন, দেশে একসময় খাদ্যভা-ার হিসেবে পরিচিত ছিল দক্ষিণাঞ্চল। লবণাক্ততা ও চিংড়ি চাষের কারণে আশির দশকের পর এখানে ফসল উৎপাদন কমে যায়। ফলে দেশের কৃষি উত্তরাঞ্চলনির্ভর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নতুন করে বরিশাল, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের বৃহত্তর ফরিদপুরের জেলাগুলোয় কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চল কৃষিতে ভরসার জায়গায় চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইফপ্রির গবেষণায় তথ্য
২০ জেলায় ধানের উৎপাদন
* ধান উৎপাদন বেড়েছে ২ শতাংশ
* চাষ কমেছে ৩.৬ শতাংশ
* আমন চাষ বেড়েছে ৩০০ শতাংশ
চার বছরে শস্য উৎপাদন এলাকা বেড়েছে
* ভুট্টা ৩৮০ শতাংশ
* ডাল ৩০ শতাংশ
* তেলজাতীয় শস্য ৩৫ শতাংশ
* আলু ৪৭ শতাংশ
সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট