বাংলা মুদ্রণশিল্প ও প্রকাশনার স্বাধীনতা প্রসঙ্গ
ফ্রিডম বা স্বাধীনতা শব্দটি অর্থব্যঞ্জনার দিক থেকে বহুমাত্রিক। চিন্তার স্বাধীনতা (Freedom of Thought) কোনো শর্তাধীন নয়। কিন্তু চিন্তা যখন অভিব্যক্ত বা প্রকাশিত হবে তখন তা শর্তাধীন। আপনি যা খুশি, যেমন খুশি চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু এই চিন্তা যেমন তেমনভাবে প্রকাশ করা যাবে না। প্রকাশের আগে ভাবতে হবে প্রকাশিত বিষয়ের সামাজিক উপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা। দ্বিতীয়ত; ভাবতে হবে পাঠক-শ্রোতার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া এবং তৃতীয়ত; প্রকাশ মাধ্যম, প্রকাশের ভাব, ভাষা ও শৈলীর কথা। এক্ষেত্রে লেখক-চিন্তক নিজেই এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপ আরোপ করেন। অর্থাৎ, চিন্তাটি প্রকাশকালেই শর্তাধীন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং খোলামেলা সমাজেও এই সেল্ফ সেন্সরশিপ কার্যকর।
আলোকিত শতাব্দী বলে কথিত ইউরোপে অষ্টাদশ শতকে মুদ্রণযন্ত্র ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এর অনুষঙ্গ ভাববিপ্লব, পুঁজিবাদের উদ্ভব, শিক্ষার বিস্তার এবং ভোক্তা হিসেবে শিক্ষিত এলিট শ্রেণির বিকাশ, সংবাদপত্র ও গ্রন্থ প্রকাশনাকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে। মুদ্রিত গ্রন্থ ও সংবাদপত্র ক্রমশ ‘পণ্য’ হয়ে ওঠে এবং প্রকাশনা ভ্রুণাবস্থা থেকে ‘শিল্প’ (Industry) হওয়ার পথে পা বাড়ায়।
বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে আমাদের আরও ‘শতবর্ষ’ অপেক্ষা করতে হয়। অষ্টাদশ শতক ইউরোপে বিভাসিত শতাব্দী হিসেবে চিহ্নিত হলেও, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ওই শতাব্দী চিহ্নিত হয়ে আছে লজ্জা, গ্লানি ও আত্মবলোপের শতাব্দী হিসেবে। অষ্টাদশ শতকে বহিরাগত ইংরেজরা আমাদের ‘মধ্যযুগীয়’ এশিয়াটিক ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নিয়ে ‘আধুনিক’ ইউরোপের পরাধীনতার শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের প্রকৃত আধুনিকতার উত্তরণ শুরু হয় শতবর্ষ পরে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ইউরোপের সাথে আপেক্ষিক সাদৃশ্য চোখে পড়বে কলকাতা-কেন্দ্রিক মুৎসুদ্দি এন্টারপ্রিনিউর শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির গড়ে ওঠার মধ্যে। শ্রীরামপুর মিশনারিদের হাত ধরে আধুনিক বাংলা গদ্যের হাঁটি হাঁটি পা পা যাত্রা শুরু। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা, ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলা বিভাগ চালু হওয়া এবং ১৮০৯ সালে পাদ্রী চার্লস উইলকিসের পৃষ্ঠপোষকতায় পঞ্চানন কর্মকারের মুদ্রণোপযোগী কাঠখোদাই বাংলা লিপিমালা তৈরির ভেতর দিয়ে বাংলা মুদ্রণ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৮১৮ সালের এপ্রিলে প্রথমে শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ এবং কিছুদিন পর ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। একই বছর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বাঙালি প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বাঙ্গাল গেজেট’ প্রকাশিত হয়।
পরাধীন ভারতে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র অবশ্য ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি অগাস্টাস হিকি প্রকাশ করেন Bengal Gazette ev Calcutta General Advertise। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিষয়টিকে সুনজরে দেখে নি। বেসরকারি ইংরেজ মালিকানার এই সংবাদপত্রটি কোম্পানি সরকারের দেশ শাসনে নানাবিধ অসংগতির সমালোচনা করার ১৭৯৯ সালে লর্ড ওয়েলেস্লি ভারতবর্ষে প্রথম সেন্সর প্রথা চালু করেন।
উপমহাদেশে এই প্রথম প্রকাশনার স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের শুরু। ১৮১৮ সালে বাংলা সাময়িকপত্র দিগদর্শন প্রকাশের বছর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সেন্সরশিপ তুলে নেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তা আরও কঠোর বিধিনিষেধসহ পুনঃপ্রচলন করা হয়।
মুদ্রণযন্ত্র মানব মনীষার বিকাশে একটা বিপ্লব সংঘটিত করে। ইউরোপের শতবর্ষ পরে শুরু হলেও মুদ্রণ শিল্প বাঙালি রেনেসাঁর অনুষঙ্গ হয়ে পড়ে। অন্যভাবে বলা যায়, মুদ্রণযন্ত্র ভারতীয় বা বাংলার রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান অনুঘটক। উনিশ শতকে যে ভাববিপ্লব, নিঃসন্দেহে তার প্রধান বাহন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত সংবাদপত্র, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। এক কথায় সাহিত্য। বলা হয়ে থাকে বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশের দুবছর আগেই, ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য সম্পাদনা করেন এবং কলকাতার Ferris and Companyথেকে ছাপিয়ে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বাংলা গ্রন্থের প্রকাশনাÑ উত্তরণকাল অতিক্রম করে। প্রকাশনা একটা শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠার পথে পা’ বাড়ায়।
বাঙালি মনীষার বহুমুখী সৃজনশীলতার বাহন হয়ে ওঠে প্রকাশনা শিল্প। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতোই সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিপুল প্রাণাবেগ ও মননশীলতার সংযোগে প্রকাশিত হতে থাকে কাব্য, মহাকাব্য, প্রহসন, নাটক, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ।
এই মহৎ কর্মযজ্ঞে তৎকালীন পূর্ব বাংলা, আজকের বাংলাদেশও শামিল হয়। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে রংপুর থেকে প্রকাশিত ‘রঙগপুর বার্তাবহ’ দিয়ে শুরু হলেও পূর্ব বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের পত্তন হয় কার্যত ঢাকা শহরে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ঢাকা প্রেস নামক মুদ্রণালয় থেকে সাপ্তাহিক The Dacca News পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এখানে প্রকাশনা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।
বাংলা প্রকাশনার পথটি নিষ্কণ্টক ছিল না। সেন্সরশিপের কথা আগেই বলেছি। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগ্রাম যত বেগবান হয়েছে, সেন্সরশিপ ততই কঠোর হয়েছে। কেবল সেন্সরশিপ দিয়েই নয়, উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সৃজনশীল সাহিত্যের সংগ্রামী ভূমিকা যত তীব্র হয়েছে, ব্রিটিশ সরকার ততই তা দমনে খড়গহস্ত হয়েছে। ‘ভারত রক্ষা’ আইনসহ নানান কালাকানুন দিয়ে মুক্তচিন্তা, বাক-ব্যাক্তি ও প্রকাশনার স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াস চলতে থাকে। প্রকাশিত বই বাজেয়াপ্ত করা, বে-আইনি বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেই তার ক্ষান্ত থাকে নি। লেখা, মুদ্রণ ও প্রকাশনার অপরাধে সংশ্লিষ্টদের নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হতে থাকে।
ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকা একটি জেলা শহর থাকায় এখানে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ছিল সীমাবদ্ধ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা। দেশভাগের অন্য নেতিবাচক ফলাফল যাই হোক, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা হয়ে ওঠে বাঙালি জাতিসত্তার নবজাগরণের আরেক কেন্দ্র।
উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ ছিল খ-িত। বাঙালি মুসলমান ছিল ঐ রেনেসাঁর বাইরে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার বিকাশোন্মুখ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, আরও স্পষ্ট করেই বলা যায়, মুসলমান মধ্যবিত্ত নতুন এক রেনেসাঁর সূত্রপাত করে।
পাকিস্তানি শাসন (১৯৪৭-১৯৭১) ছিল পূর্ব বাংলা, আজকের বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ ভাষা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কেবল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই নয়, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলাসহ বাঙালি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অচলায়তন ভেঙে মুক্তধারার সৃষ্টি হয়। শিল্প সাহিত্যের এই মুক্তধারাই বাঙালি মধ্যবিত্তের মানস গঠনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এই নবজাগরণ বা রেনেসাঁর অনিবার্য পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে প্রকাশনার স্বাধীনতা নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সেকুলারিজম এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অভীপ্সা অনুপস্থিত ছিল বলে পাকিস্তানি শাসনামলে চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং প্রকাশনার স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার বিকাশ, একুশের বইমেলা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একাধিক সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সৃজনশীল সাহিত্য ও গবেষণার বিভিন্ন শাখার গ্রন্থ ক্রয় এবং অন্যান্যভাবে প্রদেয় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। প্রকাশনা শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এখন বিশাল এক পাঠক-শ্রেণি। এই মধ্যবিত্ত পাঠক তথা ভোক্তা-শ্রেণির ক্রমোস্ফীতির কারণে আমাদের সনাতন বাংলাবাজার-কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র প্রকাশনা ব্যবসাটি এখন কর্পোরেট শিল্পে উত্তরণের মতো সাবালক হয়ে উঠেছে।
প্রকাশনার স্বাধীনতা বাংলাদেশে প্রায় নিরঙ্কুশ। আমাদের দেশে অতীতের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেনশনস অর্ডিন্যান্স-এর মতো একটা নিয়ন্ত্রক আইন থাকলেও, ঔপনিবেশিক আমলের মতো এই আইনটি প্রকাশনার স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই খর্ব করেনি। এটাকে কোনোমতেই কালাকানুন বলা যাবে না। সর্বোপরি আমাদের সংবিধানে ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেওয়া হয়েছে, যা প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং Freedom of Press-কে নিশ্চিত করেছে।
শিক্ষার বিপুল প্রসার, শক্তিশালী মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণির উদ্ভব, নগরায়ন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের বহুমুখী উদ্যোগ, বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির চর্চা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাতাবরণ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের আনুকূল্য বাংলাদেশে প্রকাশনার স্বাধীনতাকে যেমন অর্থবহ করে তুলছে, তেমনি এই শিল্পের জন্য খুলে দিচ্ছে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
নূহ-উল-আলম লেনিন