বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিন
বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাকে শুধু শহরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ না রেখে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদেশের সাথে আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের চর্চা ও সমৃদ্ধির কথা গোটা দুনিয়াকে জানানোরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একই সাথে শিশুদের জন্য বেশি বেশি করে বই লেখা ও প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছেন।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান। প্রকাশকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মাজহারুল ইসলাম। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন বিদেশি অতিথিরা। বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে মঞ্চে ছিলেন জীবনানন্দ অনুবাদক ব্রিটিশ কবি জো উইন্টার। চেক প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছেন লেখক-গবেষক রিবেক মার্টিন। প্রথমবারের মতো যোগ দেন আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন ও সাধারণ সম্পাদক জোসেফ ফেলিক্স বুরঘিনো। প্রাণের মেলা উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে প্রেরণা। একুশ আমাদের প্রতিবাদের ভাষা শেখায়। দাবি আদায়ের শক্তি জোগায়। বিজয়ের পথ দেখায়। অমর একুশের হাত ধরেই আজকের অনন্য সাধারণ বইমেলা। এর জন্য সারাবছর আমরা আকাক্সক্ষা করে বসে থাকি। এক মাস ধরে চলে মেলা। এরপরও মন ভরে না।
সুন্দরের এই চর্চা শুধু শহরে সীমাবদ্ধ রাখার বিপক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি অনেক উন্নত। শুধু শহরের মধ্যে এই চর্চা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে এসে জাতির পিতা বলেছিলেন, আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানে আবদ্ধ না হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দনও যেন প্রতিফলিত হয়। তারও আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে এসেছিলেন জাতির পিতা। তখন তিনি তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমাদের কাছে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, সে হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বলার ধরনে উচ্চারণে এই যে পার্থক্য এটা ভাষার মাধুর্য। গান কাব্য চর্চার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা তফাৎ দেখি। এটা ভাষার প্রাচুর্য।
বাংলা একাডেমির বইমেলা নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশের মানুষ এই মেলায় আসেন। দেশের বাইরে থেকেও আসেন প্রবাসীরা। এ প্রসঙ্গে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি আমার জন্য খুব বিশেষ জায়গা। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন আমার বান্ধবী বেবী মওদুদসহ বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে আসতাম। এখানে বসে বই পড়তাম। এভাবে অনেক সময় কেটে যেত। বর্তমানে এসে তিনি কিছুটা আক্ষেপ করে বলেন, এখন তো বলতে গেলে বন্দিদশা। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আগের মতো যখন তখন বইমেলায় ছুটে আসতে পারি না। এই কষ্টটা মনে রয়ে গেছে। কবে আবার মুক্তি পাব মেলায় আসতে পারবÑ জানি না।
নিজের বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৭ সালে করাচিতে এক সাহিত্য সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আইনসভায় একই দাবি তুলে ধরেন। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফজলুল হক হলে ছাত্ররা সভা করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিসহ অন্যান্য সংগঠন মিলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১১ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এই ধর্মঘটে পিকেটিং করতে গিয়ে সেক্রেটারিয়েটের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। অন্য নেতৃবৃন্দও গ্রেফতার হন। আবার প্রবল চাপের মুখে ১৫ মার্চ সকলকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি সভা হয়। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন। এখান থেকে মিছিল বের করতে গেলে আবারও লাঠিচার্জ করা হয়। টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয়। তবে, আন্দোলন থামানো যায় না। বরং তা সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু হয়। সে সময় সমগ্র বাংলাদেশে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে প্রচার অভিযান চলে। ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান তিনি। ১৪ অক্টোবর আবারও গ্রেফতার হন। প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও বলেন, পূর্ববাংলার মানুষ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। এমন বক্তব্যে আন্দোলন আরও গতি পায়। নতুন করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় কারাগারে থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে নেতা-কর্মীদের সাথে গোপন বৈঠক করতেন বঙ্গবন্ধু। এ কারণে চিকিৎসা বাদ রেখেই তাকে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সভার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওইদিন ঢাকায় ৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়। ছাত্রদের ওই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। রাজপথে সালাম বরকত জব্বার রফিকসহ অনেকের রক্ত ঝরে। পরের ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়। ফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচিতে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা হয়। ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে অমর একুশকে শহীদ দিবসের মর্যাদা দেয়। এদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। শহীদ মিনার নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। অর্থ বরাদ্দ করা হয়। নির্মাণ কাজও শুরু হয়। ’৫৬ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায়, দেশের শাসনতন্ত্র রচনা করা হয়। সেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথির মধ্যে রিবেক মার্টিন বলেন, বাঙালির ভাষা আন্দোলন এক বৃহৎ মানবিক অভিজ্ঞতা। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারাবিশ্বের উপনিবেশবাদবিরোধী শেকল ভাঙার গানে প্রেরণাদায়ী মন্ত্রের নাম। পৃথিবীর সকল বৃহৎ ও ক্ষুদ্র জাতির প্রগতিশীল-সংগ্রামী অভিযাত্রায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। একুশের শহীদের স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের আলো। তিনি বলেন, ইন্টারনেট বই পড়ার নেশাকে স্তব্ধ করতে পারবে না। আমাদের সবাইকে অনুবাদ, ভ্রমণ ও অন্য ভাষা শেখার মধ্য দিয়ে এক মানসিক ভাষা তৈরি করতে হবে যা ভবিষ্যতের মানবিক পৃথিবী গড়ার আন্দোলনকে সফল করে তুলবে।
জো উইন্টার বলেন, আমি রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ অনুবাদ করেছি, অনুধাবন করেছি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গভীরতা এবং মানবিক আবেদনের মর্ম।
রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন বলেন, মুদ্রিত ও ডিজিটালÑ উভয় বইয়ের পাইরেসি রোধ করতে বিশ্বের সকল প্রকাশক ও লেখকের সচেতনতা প্রয়োজন। শিক্ষা ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জকে আমরা এই বইয়ের মাধ্যমেই সফল করে তুলতে পারি। মানুষের সৃজনশীল অভিযাত্রায় লেখা, লেখক এবং বইয়ের কোনো বিকল্প কখনও গড়ে উঠতে পারে না।
বিশেষ অতিথির ভাষণে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, একুশে গ্রন্থমেলা নিছক বইয়ের বিকিকিনির মেলা নয়, এটি বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল অগ্রযাত্রার কেন্দ্রসূচক। এই মেলা এখন লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মহামিলন মেলা।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, একুশের গ্রন্থমেলার পরিসর ক্রমেই বাড়ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েও ভবিষ্যতে স্থান সংকুলান হবে কি-না তা ভেবে দেখার বিষয়। তাই ভবিষ্যতে যাচাই-বাছাই করে প্রকাশক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রন্থমেলা পরিচালনা করতে হবে।
গ্রন্থমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা বইয়ের ব্রেইল ও অডিও সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করেন। এই বই থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে একটি কবিতা পাঠ করেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আসিফ করিম পাটোয়ারী রূপম। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তার সবুজ মাঠ পেরিয়ে বইয়ের ব্রেইল সংস্করণেরও মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত আধুনিক বাংলা অভিধান তুলে দেওয়া হয়।
এদিন অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১০টি ক্যাটাগরিতে মোট ১১ জনকে এবার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এবার কবিতায় আলতাফ হোসেন, কথাসাহিত্যে শাহীন আখতার, প্রবন্ধে যৌথভাবে আবুল মোমেন ও আতিউর রহমান, গবেষণায় মনিরুজ্জামান, অনুবাদে আবদুস সেলিম, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে তাজুল মোহম্মদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। স্মৃতিকথা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন ফারুক চৌধুরী, নাটকে মাসুম রেজা, পরিবেশ ক্যাটাগরিতে শরীফ খান এবং শিশুসাহিত্যে সুজন বড়–য়া পেয়েছেন এই পুরস্কার। সবার হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্রী অনিন্দিতা কাজী।
অনুষ্ঠান শেষে বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সবার জন্য মাসব্যাপী মেলা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।