বাবার ডায়েরীতে ১৯৭১ (৫ম পর্ব)
এপ্রিল ২০, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ এর এম.পি খাজা আহমেদের নেতৃত্বে ফেনীর পুলিশ ও মহকুমার উপর তাদের নিয়ন্ত্রন অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। এই সময়ে পাক আর্মি চৌমুহনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সীমান্তের ভুড়ভুড়িয়ার তিন দিক থেকে ফেনী শহর ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে সম্মিলিত মুক্তি ফৌজ খাজা আহমদের নেতৃত্বে ভারতে চলে যায়। ফেনী শহর লোক শূন্য হয়ে যায়। এবং ফেনী পাক সৈন্যদের দখলে চলে যায়। খাজা আহমদ এম.পি ও মুক্তি ফৌজগন উত্তরে ভারতীয় ভূখন্ড চোত্তাখোলায় আশ্রয় লাভ করে।
চট্টগ্রাম থেকে বিপুল টেঞ্জ ও মর্টার শেলিং করে অদ্য পাক বাহিনী মস্তান নগর আক্রমণ করে। মুক্তিফৌজ মেজর রফিকের নেতৃত্বে বহু পাক সেনাকে হত্যা করে হিঙ্গুলীতে অবস্থান নেয়। পরে হিঙ্গুলীরও পতন ঘটে।
এপ্রিল ২১, ১৯৭১
অদ্য সন্ধ্যায় পাক সামরিক বাহিনী ফেনী শহরের তিনটি প্রধান প্রবেশ পথে আগাইয়া আসে। ফাইট লে. আ. রৌফ এতদিন ফেনীতে মুক্তিফৌজর কমান্ডর ছিলেন। তিনিও ভারতে চলে যান।
এপ্রিল ২৩, ১৯৭১
শুক্রবার পাক সৈন্য বাহিনী ফেনী শহরে প্রবেশ করে বিকাল ৪ ঘটিকায়। ইতিপূর্বে বাঙ্গালী ইপিআর জোয়ান ও এমপি খাজা আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা শহর ছাড়িয়া উত্তর দিকে ভারত সীমান্ত অভ্যন্তরে চোত্তাখোলা চলে যায়। এবং ছাগলনাইয়ার এমপি ওবায়েদুল্লা মজুমদার সাহেব ও সদলবলে ভারতে চলে যান। ফেনী শহর প্রেতপুরী হয়ে আছে। সব লোক গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে।
এপ্রিল ২৬, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্র বাঙ্গালী কুটনীতিক পাকিস্তান দূতাবাসের ভাইস কন্সাল জনাব এ. এইচ মাহমুদ আলী অদ্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।
এপ্রিল ৩০, ১৯৭১
অদ্য অপরাহ্ন বেলায় হরিপুর আমাদের বাড়ী থেকে দেখতে পাই পাক ফৌজের সৈন্যরা ফেনী থেকে মার্চ করে রেজুমিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ ইতিপূর্বে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা রেজুমিয়া সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষিপ্ত হয়ে পাক সৈন্যরা মুহুরী নদীর উপর রেজুমিয়া সেতুর উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলি আগুন লাগিয়ে ভস্মিভূত করে দেয়।
মে ২, ১৯৭১
রামগড়ে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মেজর মীর শওকত আলী মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন। পাক বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন সন্ধ্যার পূর্ব মূহুর্তে ফেনী নদী পার হয়ে ভারতীয় মহকুমা শহর সাব্রুম চলে যায়।
মে ১০, ১৯৭১
পাক বাহিনী ছাগলনাইয়া এসে তাদের অগ্রবর্তী ঘাটি স্থাপন করে। তবে শুভপুর এলাকা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আছে।
মে ১১, ১৯৭১
পাকবাহিনী শুভপুরের দিকে যাচ্ছে খবর পেলাম।
মে ১২, ১৯৭১
শুভপুর সেতুর দক্ষিনে করেরহাট। চট্টগ্রাম জেলার করেরহাট পাক বাহিনীর বিরাট ঘাঁটি। ঐ এলাকা তারা গত এপ্রিলেই আগুন লাগিয়ে পুঁড়ে দেয়।
শুভপুর সেতুর উত্তর পাড়ে ফেনী নদীর তীরে কয়েকজন বাঙ্গালী ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধারা এই ট্রেঞ্জ এ ছিল। করেরহাট ও ছাগলনাইয়া থেকে পাক সৈন্যরা যুগপৎ কামান দাঁগিয়ে শুভপুর সেতুর কাছে আসে এবং এক প্রচন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায়। অপরাহ্ন ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ আমাদের গ্রাম থেকে শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর পাক বাহিনী প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি স্বীকার করে শুভপুর সেতু দখল করে নেয়।
মে ১৩, ১৯৭১
এখানে উল্লেখ্য যে গত ২৫শে এপ্রিল করেরহাট পাক বাহিনী দখল করে নিলে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত শুভপুর সেতুর দক্ষিনাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এবং ঐ পুলের উত্তর প্রান্তে বাংকার তৈরী করে পাহারা দিতে থাকে। এদিকে পাকবাহিনী একের পর এক হেঁয়াখো, রামগড়, প্রভৃতি দখল করে নিলে মুক্তিবাহিনী শুভপুর ব্রীজের উত্তর পার্শ্বে এসে জমায়েত হয়। কিন্তু ২০শে এপ্রিলের পর থেকে পাক বাহিনী ফেনী শহর দখল করে ক্রমশ ছাগলনাইয়া পর্যন্ত এসে যায়। অতপর ১২ মে বুধবার পাক বাহিনী ট্রেঞ্জ ও ভারী অস্ত্র নিয়ে করেরহাট থেকে শুভপুর ব্রীজের উত্তর পার্শ্বে ভীষণ ভাবে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ভেঙে দেয়। এখানে প্রায় দুই তিনশ ইপিআর মুক্তিবাহিনীতে নিযুক্ত ছিল। তারা ঐদিন সন্ধ্যার পরই শুভপুর ছেড়ে ভারতের সাব্রুম চলে যায়।
মে ১৬, ১৯৭১
পাক বাহিনী রাস্তায়। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে অদ্য ভোর ৭টার দিকে হরিপুর নিজবাড়ি থেকে পদব্রজে চট্রগ্রাম যাত্রা করি। আমার সাথে ছিল আমাদের উত্তর পার্শ্বের বাড়ির ফয়েজ আহমদ, সে একজন টালী ক্লার্ক-হালি শহর খাদ্য গুদামের। এবং ফোরাক কাকা। ভুড়ভুড়িয়া খেয়াঘাট হয়ে পায়ে হেঁটে দুপুর ১২টায় জোরারগঞ্জ আসি। সেখান থেকে বাসযোগে বিকাল ৪টায় সিতাকুন্ড আসিয়া পৌঁছি। ফয়েজ চট্টগ্রাম চলিয়া যায়। সিতাকুন্ড ইতিমধ্যেই পাক বাহিনী কর্তৃক অগ্নিদগ্ধ। সন্ধ্যায় কার্ফু ছিল। আমার বাসার জিনিষপত্র ঠিক ছিল।
মে ২৪ ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আ. আহমদের নেতৃত্বে পাক বাহিনীকে চাঁদগাজীতে আক্রমণ করে চাঁদগাজী দখল করে নেয়। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষদূত নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন। খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
চলবে…