প্রতিবেদন

বিএনপির কাউন্সিল ‘ভীষণ’ ষড়যন্ত্র!

স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠা সেনা ছাউনিতে, প্রথম দল যেটি সরাসরি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে জন্ম। প্রথমে জাগদল পরে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট তারপর মূলদল বিএনপি প্রতিষ্ঠা পায়। এ প্রসঙ্গে ‘বিএনপির সময় অসময়’ বইয়ের লেখক মহিউদ্দীন আহমদ লিখেছেনÑ ‘জিয়া বিএনপি তৈরি করেছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে। ওই সময় যারা বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা যে বিএনপির আদর্শের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তা হয়তো বলা যাবে না। প্রাপ্তিযোগের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সন্দেহ নেই। তবে আদর্শের ব্যাপারটা যে একেবারে ছিল না তা নয়। যারা আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট রাজনীতি পছন্দ করেন না তাদের তো একটা অবলম্বন দরকার, বিএনপি হয়ে দাঁড়াল ওই রকমের একটা প্লাটফর্ম।’ [পৃষ্ঠা-৩১৯] এখানে লেখক কিছুটা এড়িয়ে গেলেও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার বইতে আরও সত্য প্রকাশ করেছেনÑ ‘বিএনপির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এই দলের জন্ম কোনো স্বাভাবিক সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়নি। একদিকে ছিল সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, গণবিরোধী, স্বার্থপর এবং রাজনৈতিকভাবে সমাজে ধিক্কৃত ব্যক্তিরা। বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে।’ [চলমান ইতিহাস : জীবনের কিছু সময় কিছু কথা-১৯৮৩-১৯৯০, পৃষ্ঠা-১৫৯-১৬০] সেই সুবিধাবাদী দলছুট ধিক্কৃতরা এখনও বিএনপিতে আছে এবং শক্তিশালী তা তৃণমূল নেতাদের কথায় কাউন্সিলে প্রকাশ পেয়েছে। কাউন্সিলদের বক্তব্যে দলের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথাও উঠে এসেছে, যা খালেদা জিয়াও স্বীকার করেছেন কিন্তু আদৌ কোনো প্রতিকার হবে কিনা সেই আশার আলো নেই।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিল শেষে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর ৬ এপ্রিল সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করার পর থেকে কাউন্সিল অনুষ্ঠানের ১১ দিন পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্তই ছিলেন। অতঃপর তাকে ভারমুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চম কাউন্সিলে দল ঘুরে দাঁড়ানোর কথা উঠেছিল; কিন্তু দলের ভেতরে-বাইরে-রাজপথে সর্বত্রই ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দলটি। সেটা ঘুচাতে ছয় বছর পর ১৯ মার্চ ছিল বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল। বর্তমানে সংসদেও নেই, তাই কার্যত বিরোধী দল তারা নয়। কাউন্সিলে খালেদা জিয়া শুধু বক্তব্য দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নি বা নিতে পারেন নি; বরং দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অসাংগঠনিক কর্মকা- তৃণমূল নেতারা তুলে ধরেছেন, যা কাউন্সিলের আগেই কয়েক নেতা বিবৃতিতে বলেছিলেন; কিন্তু এতটা তোপের মুখে কেন্দ্রীয় নেতারা পড়বেন তা হয়তো তারা আশা করেন নি। যেহেতু ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে জন্ম, তাই দেখা যায় বিএনপি রাজপথে নিজেদের মেলে ধরতে কখনই পারেনি।
কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তৃতায় মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলা সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনি বলেন, ম্যাডাম আজকের নির্বাহী কমিটিতে মুখোশধারী রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। নেতাদের টিভিতে দেখা গেলেও আন্দোলনে নেই। ম্যাডাম ভারতে একটি নির্বাহী কমিটি ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট আর আমাদের কমিটি কয়েকশ। এটা কমাতে হবে। [দৈনিক যুগান্তর, ২০ মার্চ ২০১৬]
খালেদা জিয়াও এসব বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন এবং আশ্বাস দিলেও কার্যকর করতে পারবেন কিনা সন্দেহ, কারণ ৩৭ বছরের ইতিহাসে দেখা যায় সুবিধাবাদীদের পাল্লাই বিএনপিতে ভারী, মুক্তিযোদ্ধাদের দল বলে বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা বিএনপিতে কোণঠাসা; বরং ডানপন্থি ধর্মীয় উগ্র ও কট্টরবাদীরাই বিএনপিতে শক্তিশালী, ফলে তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ না হয়ে ধ্বংসাত্মক হয়, মানুষ পুড়িয়ে তাদের আন্দোলন কর্মসূচি চালানো হয়। সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম, যদিও বক্তৃতায় খালেদা জিয়া অনেক কথা বলেছেন আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সেই চিরচেনা ষড়যন্ত্র-অসহিষ্ণুতার মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো কাউন্সিলের আগে বিএনপি সরকার-বিরোধী মিথ তৈরি করতে চেয়েছে যে সরকার তাদের কাউন্সিল করতে দিতে চায় না, ষড়যন্ত্র করছে; কিন্তু কাউন্সিল নিয়ে কথা যে মিথ্যা তা তো প্রমাণ হলোই। কাউন্সিলে বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে চাইলে ফল হলো না; বরং বিদেশি অতিথিরা বিএনপির আতিথেয়তায় তুষ্ট নয়, তাও খবরে এসেছেÑ এ যেন নাটকের পর নাটক।
কাউন্সিলের প্রথম পর্বে খালেদা জিয়া বক্তব্যে সেখানে অনেক কথা বলেছেন, ‘ভিশন’ দেখিয়েছেন; কিন্তু দলের রাজনৈতিক আদর্শগত অবস্থান পরিষ্কার করেন নি। রাজনৈতিক দলের প্রথম কাজ সময়ের দাবিগুলোর সাথে নিজ দলের অবস্থান পরিষ্কার করা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক আদর্শিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি ব্যবহার ও আচরণ, অসাম্প্রদায়িকতা, পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সম্পর্ক, এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি; কিন্তু খালেদা জিয়া সেই সব বিষয় পরিষ্কার করেন নি।
তার ভাষণ একটি নির্বাচনী ইশতেহার অথবা কর্মসূচির মতো লেগেছে, যাতে আদর্শিক অবস্থানের চেয়ে সরকার গঠন করে কী করবেন তা বোঝাতে চেয়েছেন; কিন্তু আবার নির্বাচনে আসবেন কিনা বা কীভাবে নির্বাচন চান তা না চেয়ে শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচন করতে চেয়েছেন, যাতে ষড়যন্ত্রের আভাস ঘটেছে এবং ইতোমধ্যে বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে। দুই পর্বের বক্তব্যে তার দ্বিচারিতাই প্রকাশ পেয়েছে। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন কিন্তু নিজে দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন এবং তার ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত এক সুশীল গ্রুপ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছেন, বেগম জিয়াও তাদের সুরে কথা বলেছেন। তবে কি জনগণকে বাদ দিয়ে সুশীলদের প্রতি তার টান বেশি, যাদের কোনো ওয়ার্ড নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো জনভিত্তি নেই। আর দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের জন্য যে পরিমাণ ভোট পেয়ে সংসদে যেতে হবে, তা বিএনপি পাবে সেটি এখনই কি করে নিশ্চিত হলো। বিশ্বে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা অনেক দেশে থাকলেও এই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফল প্রায় সমানে সমান। এবং আদৌ বাংলাদেশে এই বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটিও বিবেচনা করতে হবে। এমন চটকদার কথা অনেক দলই বলছে, যাদের একটি সংসদীয় আসনে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থা নেই। আর এই ব্যবস্থা চালু করতে অনেক প্রক্রিয়ারই বিষয়, সেটা বিএনপি কি করে করবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এমনকি বক্তৃতায় দলটির স্বাধীনতা-বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে সরে আসার কোনো ঘোষণা আসেনি; বরং জামাতে আমীর কাউন্সিলে উপস্থিত ছিল এবং যুদ্ধাপরাধী ফাঁসি কার্যকর হয়ে মৃত সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর নামও শোক প্রস্তাবে উচ্চারিত হয়। স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিদের সাথে নিয়ে চলার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে না এসে আগের মতোই অপরাজনীতি এবং স্বাধীনতা-বিরোধী দলের সাথে জোট করেই রাজনীতি করতে চায়, যা প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাই ধরা রাখবেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
বেগম জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ বলে যে কর্মপরিকল্পনার কথা বলেছেন এসবের অনেক কিছুই আওয়ামী লীগ আগেই তাদের দেওয়া ‘ভিশন ২০২১’ এবং ‘ভিশন ২০৪১’-এ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারাই বলছেন, বিদেশিদের খুশি করতেই এমন পরিকল্পনা পেশ। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশিরা বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করবেÑ তার পরিকল্পনা জানতে চাইতেন। কাউন্সিলের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। [দৈনিক সমকাল. ২১.০৩.২০১৬, পৃষ্ঠা-১] আর গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি বিদেশমুখী রাজনীতিই বেশি করছেন, সেই নরেন্দ্র মোদিকে তড়িঘড়ি করে শুভেচ্ছা জানানো, সুষমা স্বরাজের সাথে আগ বাড়িয়ে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া, কয়েকদিন পরপরই বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাৎ, এমনকি এও দেখা গেছে অবরোধের সময় তৃণমূলের খোঁজ না নিয়ে নেতৃবৃন্দ বিদেশিদের সাথেই বেশি সময় দিচ্ছেন। এটা শুধু যে ক্ষমতার জন্য রাজনীতি সেটিই প্রতীয়মান হয়। আবার ড. ইউনূসকে তাদের লোক হিসেবে মনে করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, নতুবা ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত সম্পাদক অন্তর্ভুক্তির হেতু কি? এই ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি নিয়ে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও বিএনপি নেতৃত্ব অনেক কথায়-বক্তৃতায় ড. ইউনূসকে বিশেষ সমীহ দেখায় সেটা কি ইউনূস সাহেবের একটি শক্তিশালী দেশে তার সহপাঠী বান্ধবী থাকার কারণে? এমন সমীহ করে বিএনপি কি নিজেদেরই হেয় করছে। তাদের ‘ভিশন’ যেমনই হোক এতে কোনো নতুনত্ব নেই। ভিশন ২০২১-এর পথ ধরে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে এবং ২০৩০-এর অনেক কথা ভিশন ২০৪১-এর মধ্যে আগেই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আর ২০৪১-কে সামনে রেখেই বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের ভিশনের অনেক কিছুই আগেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে ২০৩০-এর আগেই। বিএনপির এই ‘ভীষণে’ আদৌ কী আছে তা নিয়ে বির্তকের শেষ নেই, তবে অনেক কথাই তিনি আগেও বলেছিলেন ৯০-এর গণ-আন্দোলনের সময়, পরে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনিই প্রথম সেই সব ভঙ্গ করেছেন, জাতির সাথে প্রতারণা করেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিজ হাতে ধ্বংস করেছেন যার উদাহরণ মাগুরা, মিরপর-১০ উপনির্বাচন, মেয়র হানিফ নির্বাচিত হওয়ার পর লালাবাগে সাতজনকে খুন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিহিংসার রূপ কত বীভৎস হতে পারে। এমনকি ২০০১-এ ক্ষমতায় আসার পরও একই কাজ করে গেছেন ঢাকা-১০ আসনে ফালুকে নির্বাচিত করে এবং ২০০৭-এ পুনরায় নির্বাচনে নীল নকশার মাধ্যমে জয়ী হতে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার বানিয়েছিল এই বিএনপি।
বিএনপির বিদেশনীতি অনেক বিভ্রান্তিকর, কারণ ক্ষমতা থাকলে এক নীতি, না থাকলে আরেক নীতি, তবে পাকিস্তান ও ইসলামি রাষ্ট্রগুলোকে তারা সবসময় কাছে টানতে তৎপর এবং ভারত-বিরোধিতা তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র এবং জন্মগত বৈশিষ্ট্য; কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ভারত তোষণও কম নয়। যদিও বিএনপি-জামাত জোট ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলনে সহযোগিতা করেছিল আর এখন উল্টো কথা বলছে, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চালাতে দেবে না। অথচ সংসদে দাঁড়িয়ে সাত রাজ্যের ‘স্বাধীনতাকামী’দের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বক্তব্যও রেখেছেন। আসামের উলফা গেরিলাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী ও নেতা এবং বিশেষ সংস্থার সহায়তায় অস্ত্র সরবরাহকালে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার পর দিবালোকের মতো বিষয়টি পরিষ্কার হয়, বিএনপি কীভাবে উলফাদের সহায়তা করে আসছিল। সেই ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে একটিতে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামাতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়–য়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছেন আদালত এবং রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক ও সাক্ষী মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি।
‘বিএনপি অন্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করতে চায় না।’ তাদের এই কথা মনে হয় আর কেউ বিশ্বাস করে না। আর পাকিস্তানের সংসদে যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে সমালোচনা হয় তখন সবাই প্রতিবাদ করলেও বিএনপি যেন অনেকটা খুশিই হয়। ভারতে সাথে সম্পর্কোন্নয়নে খালেদা জিয়া কখনই সচেষ্ট ছিলেন না, গঙ্গা পানি চুক্তির কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধানে কোনো তৎপরতা দেখান নি; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই শান্তিপূর্ণভাবে এসব সমস্যার সমাধান করেছেন। বিএনপি তবে কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তা-ই বিরাট প্রশ্ন। খালেদা জিয়ার ভাষণের মধ্যে অতীতের অপকর্ম সন্ত্রাস দুর্নীতির জন্য কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি, ইতিহাস বিকৃতি মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করা, শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এসব বিষয়ের কোনো নিষ্পত্তি তার কথা আসেনি যা কোনো রাজনৈতিক দল এড়িয়ে যেতে পারে না; বরং এসব বিষয় এড়িয়ে গিয়ে বিএনপি যে স্বাধীনতা-বিরোধী আদর্শকে ধারণ করছে, তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থন করছেন কি-না এবং জামাত নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কিছুই বলেন নি খালেদা জিয়া; বরং ২০ দলীয় জোট থাকবে। কারণ জামাত ছাড়া বিএনপি চলতে পারবে না।
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া এমন লোভনীয় বক্তব্য আগেও দিয়েছেন কিন্তু তাদের কথা ও কাজে মিল নেই। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি যখন ভাষণ দিয়ে বলছিলেন, তিনি শান্তি চান, অশান্তি বিশৃঙ্খলা চান না তখন কিন্তু সারাদেশে তাদের দলের নেতাকর্মীরা তা-ব করছিল, যানবাহন পুড়ছিল, আগুন দিচ্ছিল। এরপর ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার চিত্র কারও মন থেকে বিস্মৃত হয়নি। আর ক্ষমতায় থাকতে তাদের অপশাসন দুর্নীতি লুটপাট কেউ এখনও ভুলেনি। দুর্নীতির দায়ে তার দুই ছেলেকে বিদেশ যেতে হয়, বিদেশের কোর্টে তাদের দুর্নীতির বিচারে দ- হয়, বিদেশ পাঠানো টাকা দেশে ফেরত আসেÑ এসব শুধরাবেন কি করে আর এসব অপকর্মের পর কেনই বা মানুষ তাদের বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করার কোনো কারণও নেই, কারণ ২০১৫ সালের শুরুতে ১০০ দিন যে তা-ব সহিংসতা করেছেন তা ভুলবার নয়, এসব নৃশংসতা একাত্তরে পাকহানাদারদের অত্যাচার নির্যাতনকেই মনে করিয়ে দেয়।
এটা দিবালোকের মতো সত্য, তারেক জিয়া এদেশে দুর্নীতির অন্য নাম। খালেদা জিয়ার সরকারের আড়ালে হাওয়া ভবন খুলে তারেক জিয়া এদেশে দুর্নীতির নব্য ধারা তৈরি করে এবং অভিযোগ আছে, হাওয়া ভবন থেকে জোট আমলে ২ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করে। তখনই দুই সরকার ব্যবস্থা চলে একটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আরেকটি হাওয়া ভবন। সিনিয়র মন্ত্রীরাও নিয়মিত হাওয়া ভবনে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসত। হাওয়া ভবনের কুকীর্তির কথা বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার বই ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র-১৯৯১-২০০৬’ বইতে লিখেছেন, তা নিয়ে কিন্তু বিএনপি কোনো কথাই বলতে পারেনি। তারেক রহমান কয়েক বছর ধরে লন্ডনে থাকছেন, তার খরচ কে দেয়? এত টাকা সে কোথাও পেল বা পাচ্ছে এই নিয়ে বিএনপি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তারেক রহমানের নানা কটূক্তির কারণে আদালত এদেশে তার বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে; কিন্তু কাউন্সিলে তারেক রহমানের ভিডিও বার্তা প্রচার করে আইনের লঙ্ঘন করেছে, যা গর্হিত কাজ হয়েছে। যাদের দেশের আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নেই তারা কি করে মানুষের উন্নয়ন করবে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেবে? বর্তমানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজনই এতিমের টাকা আত্মসাৎ ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত, এত নীতিকথা বলেও খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে জাতিকে কি পথ দেখাবেন, তা বোধগম্য নয়। বরং এক ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়।
সবার মনে আছে, জিয়াও তথাকথিত ১৯ দফা, খালকাটা কর্মসূচি দিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন, আর প্রতিদিন সকালে সশস্ত্র বাহিনীতে হত্যা চালাতেন, সেনা ও নৌবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের সেই সময় হত্যা করা হয়। মুখে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে জিয়া রাজাকার স্বাধীনতা-বিরোধীদের এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন, কারফিউ গণতন্ত্র চালু করেছিল। খালেদা জিয়াও সেই একই নাটক মঞ্চস্থ করতে চান; কিন্তু ভুলে গেছেন মানুষ আজ শিক্ষিত সচেতন।
এখন নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলছেন আবার কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জে বলেছিলেনÑ ক্ষমতায় যেতে আরও লাশ চাই, রক্ত চাই। বিএনপির চরিত্র এত দ্রুত কি করে পাল্টাবে যেখানে দলের তৃণমূল নেতারা বলছেÑ সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী দলে অনেক। খালেদা জিয়া নিজে বলছেন যে, দলে বেইমান ও মীরজাফর আছে। এদের নিয়ে কি নতুন ধারার রাজনীতি করবেন তিনি, এ তো মনে হচ্ছে নতুন বোতলে পুরনো পানীয়! খালেদা জিয়া সেই আশার কথা বলছেন, তাতে মনে হয় না দল জাগবে, জনগণ তো অনেক পরের কথা। এখনও মহাসচিবের নাম ঘোষণা করতে পারেন নি তাদের মতানৈক্যের কারণে, তবে তিনি কীভাবে দেশকে গণতন্ত্রের বাতাবরণে আবদ্ধ করবেন, ভিশন বাস্তবায়ন করবেন? আমাদের অনেক সুশীলদের মধ্যে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, এসব সুশীলদের ভূমিকা আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, গণতন্ত্রহীনতায় যেন তাদের বেশি বিশ্বাস। ১/১১-এর সময় তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা মানুষের মনে নেতিবাচক হিসেবে দাগ কেটে আছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি-জামাতের তা-বের সময় তাদের নীরবতাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভারসাম্য, সামাজিক সমঝোতা এসব তিনি সুশীল সমাজদের কাছে টানার জন্যই বলেছেনÑ এই সুশীল সমাজ এখন খুশিতে বাকবাকুম খালেদা জিয়ার ভীষণ বিভীষণ পেয়ে; কিন্তু বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া তাদের শরীরে লাগলেও সরকারের সমালোচনায় সদাই পঞ্চমুখÑ আসলে এন্টি আওয়ামী লীগ শ্রেণি, দল কিংবা নানা প্লাটফর্মে থাকলেও তাদের মূল কাজ শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করা, তা আওয়ামী লীগ যত ভালো কাজই করুক না কেন, এবং বিএনপিও এসব তথাকথিত জ্ঞানীদেরই সাথে রাখেÑ এবং থাকেই।
বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ না করলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চিন্তা করে লাভ হবে না, তাই কাউন্সিল করে বা আশ্বাসের বুলি শুনিয়ে নেতা-কর্মীদের বাড়ি ফেরত পাঠালেও বিএনপি মানুষের কাছে যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে, নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হবে না, জনবিচ্ছিন্নতা আরও বাড়বে এবং ভেতরে-বাইরে যে স্বাধীনতা-বিরোধী উগ্রপন্থিদের ঘুণপোকাদের আস্ফালন তা দলকে আরও ডুবাবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *