ইতিহাস : প্রবন্ধ

বিদায় কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

উত্তরণ প্রতিবেদন: থেমে গেল গানে গানে স্বাধীনতাকে খুঁজে ফেরা কণ্ঠস্বরটি। একাত্তরের শহীদদের ভালোবাসা জানিয়ে আর গাইবেন নাÑ সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে…। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে কণ্ঠকে হাতিয়ার করার কিংবদন্তি শিল্পী গেয়েছিলেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। সবাইকে ছেড়ে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন আবদুল জব্বার। মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দসৈনিকের প্রস্থান ঘটে গত ৩০ আগস্ট। ‘পিচঢালা এই পথ ছেড়ে’ পাড়ি জমালেন অদেখার ভুবনে। ৩০ আগস্ট সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। রেখে গেলেন জীবনসঙ্গী হালিমা জব্বার, দুই ছেলে মিথুন জব্বার ও বাবু জব্বার এবং মেয়ে টুনটুন জব্বারকে। তার দ্বিতীয় সংসারে রয়েছেন আরেক স্ত্রী শাহীন জব্বার ও মেয়ে মুনমুন জব্বার।
মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। বরেণ্য এ সংগীতশিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন সংগ্রামী শিল্পী আবদুল জব্বার। ১৯৫৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। ওস্তাদ ওসমান গণি ও ওস্তাদ লুৎফুল হকের কাছে তিনি সংগীতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম বেতারে এবং ১৯৬৪ সালে টিভিতে প্রথম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন ও স্থায়ী শিল্পী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। শিল্পীর সংগীত জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অবদান হচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান।
অসংখ্য কালজয়ী গানে কণ্ঠ দেওয়া এ শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গেরিলাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জনগণকে উজ্জীবিত করেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ টাকা তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুম্বাইয়ে ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত তৈরিতেও নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
গুণী এ শিল্পী সংগীতের নানা ঘরানার কয়েক হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, এ ভুবনে কে আপন, এ মালিকে জাহান, আমার সে প্রেম, আমি বসন্ত হয়ে এসেছি, আমি এক নীড় হারা পাখি, আমি নীরবে জ্বলতে চাই, আমি প্রদীপের মতো আলো দিয়ে যাব, আমি তো বন্ধু মাতাল নই, ভালোবাসা যদি, বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা, দু’জাহানের মালিক তুমি, এ আঁধার কখনও যাবে না মুছে, এক বুক জ্বালা নিয়ে, জানি কবিতার চেয়ে তুমি, কে যেন আজ ডেকে নিয়ে যায়, খেলাঘর বারে বারে, কি গান শোনাব ওগো বন্ধু, সালাম সালাম হাজার সালাম, ওরে নীল দরিয়া, মুখ দেখে ভুল করো না, মুজিব বাইয়া যাও রে, হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে গান।
আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়…’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে…’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান ৩টি ২০০৬ সালে মার্চ মাসজুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
অসংখ্য চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আবদুল জব্বার। যেসব চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন সেগুলো হলোÑ মেঘের পর মেঘ, অধিকার, মাস্তান, জীবন তৃষ্ণা, আলোর মিছিল, জয় পরাজয়, মা, বেঈমান, ঝড়ের পাখি, আপন পর, দাতা হাতেম তাই, বিনিময়, এতোটুকু আশা, কত যে মিনতি, মানুষের মন, অবুঝ মন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, অনুরাগ, দীপ নেভে নাই, পীচ ঢালা পথ, ঘর জামাই, সারেং বউ, ঈমান, যে আগুনে পুড়ি, সাধু শয়তান, আগুনের আলো ও স্লোগান।
সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে আবদুল জব্বারকে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৯৬ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু পদক, বাচসাস পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *