বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবনাবসান
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, মহান জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের অন্যতম সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের সাব-কমান্ডার অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, বর্ষীয়ান রাজনীতিক শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৪টা ২৪ মিনিটে রাজধানীর ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোক গমন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে তার নিজ জেলায় তিন দিনের শোক পালিত হয়।
প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, বিদেশি দূতাবাসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানগণ।
এর আগে, ঢাকেশ্বরী মন্দির ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঝিগাতলার বাসভবনে সর্বস্তরের জনগণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে বর্ষীয়ান এ নেতার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক পংকজ ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষের নেতৃত্বে মিশনের ভক্তবৃন্দ, বাংলাদেশ পূজা পরিষদ, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ভারতীয় হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার আদশ সাইকি, পলিটিক্যাল সেক্রেটারি রাজেশ উকি প্রমুখ।
জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব : গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সংসদীয় গণতন্ত্রের আজীবন পূজারী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে তার প্রতি সর্বসম্মত শোক জানায় জাতীয় সংসদ। অধিবেশনের শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং শেষকৃত্য অনুষ্ঠান : ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সুরঞ্জিতের মরদেহ রাখা হয় ল্যাবএইডের হিমঘরে। পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেওয়া হয় সিলেটে। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বহনকারী হেলিকপ্টার। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে মরদেহ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের নেতৃত্বে সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল মরদেহের সাথে সিলেট গমন করেন। বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা সুরঞ্জিতের মরদেহ রাখা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে। ভাটি বাংলার প্রাণপুরুষ হিসেবে খ্যাত সিলেটের কীর্তিসন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে সকাল থেকেই নামে জনতার ঢল। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় তার কফিন। সেখান থেকে হেলিকপ্টারযোগে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সুরঞ্জিতের নিজ জেলা সুনামগঞ্জে। সুরঞ্জিতের মরদেহ হেলিকপ্টারে সুনামগঞ্জে পুলিশ লাইনস পৌঁছার পর প্রথমে ডিসির কার্যালয় প্রাঙ্গণে স্মৃতিস্তম্বের পাশে রাখা হয়। সেখানে তার মরদেহে ফুল দিয়ে সম্মান জানান সর্বস্তরের মানুষ। তার মরদেহ নির্বাচনী এলাকা শাল্লার শাহিদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পৌঁছায় আড়াইটায়। বিকেল ৪টায় দিরাই হেলিপ্যাড থেকে নেওয়া হয় জগন্নাথ জিউড় আখড়ায় ধর্মীয় রীতিনীতি শেষে আওয়ামী লীগ কর্যালয়ের সামনে গার্ড অব অনার দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় দিরাই ঐতিহসিক বালুর মাঠে। এরপর বিকেলে হাজারও শোকার্ত মানুষের উপস্থিতিতে আনোয়ারপুর নিজ বাসভবনে তার শেষকৃত্যা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
বর্ণাঢ্য জীবন : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের আনোয়ারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে আইনে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ল’ পাসের পর কিছুদিন তিনি আইন পেশায়ও যুক্ত ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতির ছেড়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই টুকরা হলে মওলানা ভাসানীকে ত্যাগ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
পরে ন্যাপের ভাঙনের পর গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপনির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন তিনি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান।
২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। কিন্তু ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পরের বছর ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তার মন্ত্রিসভায় রেখে দেন। এপিএস’র অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুরঞ্জিত সেনকে নির্দোষ ঘোষণা করলে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি।
২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন তিনি। ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের একজন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি আবারও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সংসদীয় বোর্ডের সদস্য মনোনীত হন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন জনদরদি ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদÑ প্রকৃতপক্ষেই তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। বৃহৎ সিলেট অঞ্চলের তথা সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের সিংহ পুরুষ। যার ফলশ্রুতিতে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি সুনামগঞ্জের একটি আসন থেকে মোট সাতবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সারাজীবন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন, বিএনপি-জামাত জোটের দুঃশাসন-বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অগ্রজ। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশের মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবব্ধ, আপসহীন নেতৃত্বের অন্যতম পৃথিকৃৎ। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক প্রগতিশীল উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিক। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে দেশবাসীর ন্যায় ‘উত্তরণ’ পরিবারও গভীর শোকাহত।