প্রতিবেদন

বিশ্বসন্ত্রাসবাদ বিরোধী সূচকে উন্নতি বাংলাদেশের

 বিশ্বের সন্ত্রাসপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫ নম্বরে। গত বছরের তুলনায় সূচকে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে ছিল ২৩ নম্বরে। বিশ্ব সন্ত্রাসপ্রবণ ১০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তান (৪) ও ভারত (৬) রয়েছে। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে শীর্ষে ইরাক (১)। দেশটির স্কোর ১০। অন্য দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান (২), স্কোর ৯ দশমিক ২৩; সিরিয়া (৫), স্কোর ৮ দশমিক ১০; ইয়েমেন (৭), স্কোর ৭ দশমিক ৬৪; সোমালিয়া (৮), স্কোর ৭ দশমিক ৬; লিবিয়া (৯), স্কোর ৭ দশমিক ২৯ এবং থাইল্যান্ড (১০), স্কোর ৭ দশমিক ২৭।
ওয়াশিংটনভিত্তিক দি ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (জিটিআই) গত ২০ নভেম্বর তাদের ওয়েবসাইটে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সূচক প্রকাশ করে। মোট ১৬২টি দেশের ওপর অনুসন্ধান ও জরিপ চালিয়ে এই সূচক তৈরি করা হয়। এতে সময় লেগেছে ১৫ বছর। ২০১৪ সালের সন্ত্রাসবাদ সূচককে ভিত্তি করে চলতি বছরের সূচক তৈরি করা হয়। সন্ত্রাসবাদের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তিত কৌশল, নাশকতা বা হামলার ধরন, যেসব সন্ত্রাসী সংগঠন বা দল জড়িত, দেশটির জাতীয় পর্যায়ে আর্থ-রাজনৈতিক বিরূপ প্রভাব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের সূচকটি তৈরি করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে সন্ত্রাসী প্রবণতা ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। একুশ শতকের শুরু থেকে সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালে সন্ত্রাসী নৃশংসতায় ৩ হাজার ৩২৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬৮৫।
বিগত বছর সন্ত্রাসপ্রবণ দেশের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৩-এ। চলতি বছর এই প্রবণতা কিছুটা ভালো। কেননা, অবস্থান দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে। পাশাপাশি গত বছর পাকিস্তানের অবস্থান শীর্ষ দশের ৩ নম্বরে ছিল। এবার এক ধাপ নিচে। ভারত ও আফগানিস্তানের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
মোট ১১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিশ্বের ৫টি দেশে লাগাতার সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছে। দেশগুলো হলোÑ ইরাক, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সিরিয়া।

২০৫০ সালে কেমন হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি? বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর কত কাছে থাকবে বাংলাদেশ? কতটা এগোবে বাংলাদেশ? এ নিয়ে বৈশ্বিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এতে বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আগামী ৩৫ বছরে কতটা শক্তিশালী হবে, তা নিয়ে গবেষণা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস (পিডব্লিউসি)। প্রতিষ্ঠানটির ‘২০৫০ সালের বিশ্ব : বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন কী চলবে?’ শীর্ষক সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশ নিয়ে এমন আশাবাদের তথ্য উঠে এসেছে। পিডব্লিউসির গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাত্র ৩টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে। এই ৩টি দেশ হলোÑ বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনাম।
একটি দেশের অর্থনীতি কতটা বড় ও শক্তিশালী, সেটি নির্ধারণে সর্বস্বীকৃত দুটি উপায় আছে। একটি হলো ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপির আকার, অন্যটি হলো বাজার বিনিময় হারের (এমইআর) ভিত্তিতে জিডিপির আকার। দুই হিসাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি উঠে এসেছে গবেষণাটিতে। পিপিপির ভিত্তিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৫৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বা ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের ৩১তম বৃহৎ অর্থনীতি। ১ হাজার ২৯১ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৯তম। ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৩তম। তখন জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
বিনিময় হারের ভিত্তিতেও বড় হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এমইআর হিসাবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৩২তম। এ হিসাবে ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৮তম হবে বৃহৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই ৩৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখনকার তুলনায় ১৩ গুণ বড় হবে।
এখানেই শেষ নয়, সুখবর আছে আরও। পিপিপির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীনের প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালের পর কমবে। ফলে বহুজাতিক পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে তাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য বেছে নেবে। এতে রপ্তানিনির্ভর অনেক শিল্প এ দেশগুলোতে চলে আসবে এবং উচ্চ বেতনের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
আগামী ৩৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি ভালো খবর হবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রবৃদ্ধি। এ সময় বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যোগ হবে।
জিডিপির বিপরীতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিও আগামী ৩৫ বছরে বাড়বে বাংলাদেশে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত এদেশে জিডিপির বিপরীতে বিনিয়োগ হবে গড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশ, পরবর্তী সময়ে এই বিনিয়োগ বেড়ে হবে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশে খর্বকায় শিশুর সংখ্যা হ্রাসে বড় অগ্রগতি
খর্বকায় শিশুর হার হ্রাসের ক্ষেত্রে যে ৬টি দেশে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদনে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। তালিকার অন্য দেশগুলো হচ্ছেÑ কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, ঘানা, ভারত ও কেনিয়া। রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে গত ৪ নভেম্বর ২০১৫ সালের বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) তৈরি এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। ২০১১ সালে ৪১ শতাংশ শিশু খর্বকায় ছিল। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গড় বার্ষিক খর্বতা হ্রাসের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ বিন্দু (পার্সেন্ট পয়েন্ট)। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো হয় ৫৫ শতাংশ শিশুকে। অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা কেন্দ্রের পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, খর্বতা কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন খারাপ নয়। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ এখন দেখা দিচ্ছে। নারীদের মধ্যে স্থূলতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি অপুষ্টিজনিত রোগ। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।

বিআইডিএসের গবেষণা
সাড়ে ৩ কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত
বাংলাদেশে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল অংশ চাকরি করে। তারা এখন ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। টাকা-পয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে।
এই তথ্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)। গবেষণাটি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। গত ৫ নভেম্বর গবেষণার এই ফল প্রকাশ করা হয়। যারা দৈনিক ২ থেকে ৩ ডলার (পিপিপি হিসাবে) আয় করেন, তাদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই হিসাবটি স্বীকৃত। বিআইডিএস এই গবেষণাটি করেছে ঢাকা শহরের ১২টি এলাকায়। গবেষণার নমুনার সংখ্যা ৮০৯।
এ প্রসঙ্গে বিনায়ক সেন বলেন, মধ্যবিত্তের সেই হিসাবটি ২০১০ সাল ধরে করা হয়েছে। অতীতের একই প্রবণতা ধরে নেওয়া হলে ২০১৫ সালে এসে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ২২ শতাংশ হবে। বিনায়ক সেনের এই হিসাবটি বিবেচনায় এনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত ৫ নভেম্বর রাত ৮টা ৫২ মিনিটে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার ৭৩১ জন। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী হলো ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৬ হাজার ৬৬৪ জন। মূল গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। প্রায় দুই দশক পর এই মধ্যবিত্তের হার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এ সময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে দারিদ্র্য বিমোচন দ্রুত হয়েছে। উন্নয়ন টেকসই হয়েছে। গবেষণা সম্পর্কে বিনায়ক সেন বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আরও বিকাশ হলে প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো হবে। এতে উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও চাকরিজীবীর সংখ্যা বাড়বে। যত বেশি চাকরিজীবী বাড়বে, প্রবৃদ্ধিও সুসংহত হবে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রটি কেমনÑ তাও এই গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে যত মধ্যবিত্ত রয়েছে, এর ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করে। আর ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করে। মধ্যবিত্তদের মাত্র প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করে। নি¤œমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। আর ব্যবসায় সম্পৃক্ত মাত্র ১৭ শতাংশ। একসময় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। গবেষণায় ফলাফলে দেখা গেছে, ২৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। আর বাংলা মাধ্যমে পড়ে দুই-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা। তবে নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭৫ শতাংশই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারেও মধ্যবিত্তের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ মধ্যবিত্ত তাদের বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। উচ্চবিত্ত ও নি¤œবিত্তের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ ও ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে প্রবাসী-আয় পায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্ত পরিবার।
মধ্যবিত্তদের মধ্যে আর্থিক খাতে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতাও বেশ ভালো। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৯৬ শতাংশ মধ্যবিত্তের ব্যাংক হিসাব আছে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রাখে। আর প্রায় ১৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে।
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, মধ্যবিত্তদের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পরের স্তরে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। আর্থিক খাতের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। মধ্যবিত্তদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন-বিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এফএও’র ২০১৩ সালের সর্বশেষ বৈশ্বিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, ফল উৎপাদনের দিক থেকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল বিশ্বের পর্যায়ক্রমে শীর্ষস্থানে রয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে দুই বছর ধরে বাংলাদেশের ফলের উৎপাদন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছেÑ এই তথ্য উল্লেখ করে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৫-এর পরিসংখ্যান দিয়ে হিসাব করলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও এগোবে। এখনও এই হিসাব এফএও প্রকাশ করেনি।
এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। আর হেক্টরপ্রতি ফলের উৎপাদন ১০ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদনের এই দুই দিকে বাংলাদেশের ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। অথচ ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে ফল উৎপাদন বেড়েছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত চার বছরে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ও আনারসের মতো দেশি ফল উৎপাদন দ্রুত হারে বাড়ছে। সংস্থাটির ২০১৫ সালের প্রধান ফসলের পরিসংখ্যান বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদন নিয়মিতভাবে বাড়ছে।
বিবিএসের হিসাবে গত চার বছরে দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন বেড়েছে পেয়ারার। এই সময়ে দেশে পেয়ারার ফলন দ্বিগুণ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে কাজী পেয়ারা চাষের মধ্য দিয়ে উন্নত জাতের পেয়ারা চাষ দেশে শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ৬টি উন্নত জাতের পেয়ারা এবং বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া থাই পেয়ারার চাষে দেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে।
বিবিএসের হিসাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে পেয়ারার ফলন প্রায় আড়াই লাখ টন হবে বলে সংস্থাটির প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, এ বছর পেয়ারার উৎপাদন ৩ লাখ টন ছাড়াবে। বিবিএসের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২ লাখ টন লিচু, ৪ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁপে, ৪০ হাজার টন কমলা, ৩ লাখ ৭০ হাজার টন আনারস ও ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কুল উৎপাদিত হয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি টন। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, দেশে বর্তমানে ৪৫ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ১ কোটি টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেড়েছে আমের উৎপাদন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর এ বছর তা বেড়ে ১৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।

উচ্চশিক্ষায় ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বলছে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে জাতীয় উন্নয়ন এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বেশ কিছু দেশ। এদের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এদেশে শিক্ষার মান বেড়েছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ¯œাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়েন। ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের এই হার এশিয়ার সর্বোচ্চ দেশের তালিকায় আছে।
ইউনেস্কোর বৈশ্বিক বিজ্ঞান প্রতিবেদন ২০১৫-এ এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত ১০ নভেম্বর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে দেশে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য ১৮ লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৫০ হাজার। এই সময়ে প্রকৌশলে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৮ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইউনেস্কো বলছে, ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তির হার বেশি হলেও খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পিএইচডি ডিগ্রির (গবেষণা) জন্য ভর্তি হন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রকৌশলীরা। ২০০৯ সালে ১৭৮ প্রকৌশলী পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১২ সালে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে হয় ৫২১। প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭ হাজার ৯০ পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছেন। অন্যদিকে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৯।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০১২ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
‘ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট : টুয়ার্ডস ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক দেশ জাতীয় উন্নয়ন এজেন্ডায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে যুক্ত করেছে। ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পরও গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। প্রতিবেদনে কিছু বৈশ্বিক প্রবণতার কথা বলা হয়েছে। দেখা গেছে, ফলিতবিজ্ঞানে বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বিজ্ঞান ও গবেষণা খাতে সরকারি ব্যয় কমে গেছে। এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আগের মতো আছে বা বেড়েছে। অন্যদিকে নি¤œ আয়ের দেশগুলোতে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উত্তর-দক্ষিণের ব্যবধান কমেছে। তৃতীয়ত, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন পৃথিবীতে বিজ্ঞানীর সংখ্যা বেশি এবং তারা এক জায়গায় স্থির নন। ২০০৭ সালের চেয়ে ২০১৪ সালে গবেষক ও বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষার মান বেড়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ২০১০ সালে মাধ্যমিক স্তরে শ্রেণিকক্ষে গড়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭২। ২০১৩ সালে কমে ৪৪ জনে দাঁড়ায়। প্রাথমিক স্তরে পুনর্ভর্তির হার ১৩ থেকে কমে ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধিবিষয়ক প্রকল্পের (২০০৯-১৮) মধ্যবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষার মানে সন্তোষজনক অগ্রগতি হচ্ছে।
ইউনেস্কোর ৮২০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে অন্যান্য বেশ কিছু দেশের মতো বাংলাদেশ বিষয়ে পৃথকভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, কৃষিপ্রযুক্তি বাংলাদেশে উৎপাদনশীলতা ত্বরান্বিত করেছে। ৪৭টি নতুন প্রযুক্তি ১৩ লাখ ১০ হাজার কৃষক ব্যবহার করছেন, ২০০টি ফলিত গবেষণায় অর্থায়ন করা হচ্ছে, কৃষিতে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ১০৮ নারী ও পুরুষ বিজ্ঞানীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে, কৃষকদের জন্য ৭৩২টি তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র খোলা হয়েছে, শস্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ৩৪টি প্রযুক্তি ১৬ হাজার কৃষক ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন।
২০০৫ সালে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ছিল ২৮৩টি। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯৪-এ। ইউনেসকো বলছে, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখার সময় বাংলাদেশি বিজ্ঞানী বা গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সহপ্রবন্ধকার হিসেবে সাথে রাখছেন। অন্যদিকে দেশে অবস্থানরত বিজ্ঞানী বা গবেষকদের চেয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মেধাস্বত্বের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
নারী-পুরুষের বৈষম্য রোধ।
বিশ্বে নারী ও পুরুষের মধ্যে আয়বৈষম্য ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে কম। এমনকি লিঙ্গভিত্তিক আয় সমতায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে নারী-পুরুষের আয় সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১০৮ আর পাকিস্তানের ১৪৪-এ।
নারী-পুরুষের আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম গত ১৮ নভেম্বর ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’ প্রকাশ করে। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নÑ এই চার বিভাগে প্রতিবছর এ সূচক প্রকাশ করা হয়।
সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতির পাশাপাশি স্কোরেও অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল শূন্য দশমিক ৬৯৭, এবার তা বেড়ে শূন্য দশমিক ৭০৪ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এই মাপকাঠিতে আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২২তম। এবার ২৭ ধাপ এগিয়ে ৯৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৯৭১।
বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ করে এগিয়েছে নারীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও। শিক্ষায় অংশগ্রহণে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম, স্কোর শূন্য দশমিক ৯৪৮। গত বছরের মতো এবারও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে উচ্চ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গত বছরের ১১৮তম অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে ১১৯তম অবস্থানে।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গতবারের দশম থেকে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবার অষ্টম; স্কোর শূন্য দশমিক ৪৩৩।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে টানা ৯ বছর ধরে লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে বাংলাদেশ।
২০০৭ সালে বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে ১০০তম, ২০০৮ সালে ১৩০টি দেশের মধ্যে ৯০তম, ২০০৯ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৯৩তম, ২০১০ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৮২তম, ২০১১ সালে ১৩৫টি দেশের মধ্যে ৬৯তম, ২০১২ সালে ১৩৫টি দেশের মধ্যে ৮৬তম, ২০১৩ সালে ১৩৬টি দেশের মধ্যে ৭৫তম, ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে ৬৮তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এ বছরের সূচকে ফ্রান্স ১৫, যুক্তরাজ্য ১৮ ও যুক্তরাষ্ট্র ২৮তম অবস্থানে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *