‘বীরাঙ্গনা উপাধি নয়, খাওয়ার নিশ্চয়তা চাই’ : আলেয়া বিবি
‘একাত্তরে আমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। আমাদের বাড়িটা ছিল রাস্তার পাশেই। আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে রাস্তার পাশে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় লক্ষ করলাম পাকিস্তানি আর্মি আসছে। খাকি পোশাক পরা আর্মিদের দেখে আমরা ভয়ে বাড়ি চলে এলাম। পেছনে ফিরে দেখি আর্মির লোকগুলো আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। দৌড় দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতেই পেছন থেকে চুলের মুঠি ধরে দিল এক টান। ফিরে দেখি বড় মোছওয়ালা এক আর্মি। তার পেছনে আরো কয়েকজন। হনুমানের মতো তারা কিছুক্ষণ আমাকে নিয়ে খেলল। আমি চিৎকার দিতেই বেরিয়ে এল আমার দাদা ও চাচি। আর্মিদের কাছ থেকে তারা আমাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই গুলি করে আমার সামনেই দাদা ও চাচিকে তারা হত্যা করল। পুরো উঠান রক্তে লাল হয়ে উঠল। প্রকাশ্যে যখন আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক হাত চলে এল তখন আমার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। রাগে ক্ষোভে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এক পাকিস্তানি আর্মির গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই একটা বড় আওয়াজ শুনলাম। বুঝতে পারলাম কে জানি আমার বাম হাতটা নিয়ে গেছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে শুনেছি, ওই দিনই আমাদের পার্শ্ববর্তী সালকমুড়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।’
এভাবেই তার ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা বলছিলেন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের ভুবনঘর গ্রামের আলেয়া বিবি।
এই মা আরো বলেন, ‘আমাদের গ্রামে হত্যা-নির্যাতন চালালেও পাকিস্তানি বাহিনী ওই যুদ্ধে পরাজিত হয়। পরে সালকমুড়া যুদ্ধের কমান্ডার নায়েক সৈয়দ নজির, বর্তমান আদর্শ সদর উপজেলার সাংগঠনিক কমান্ডার মোশারফ হোসেন, আমড়াতলী ইউনিয়নের বর্তমান কমান্ডার রইছ ও ল্যান্স নায়েক আবদুল জলিলসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় আমাকে ভারতের আগরতলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুদিন পর যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন দেখি আমি আগরতলায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার মাথার পাশে মা-বাবা বসে বসে কাঁদছে। হাসপাতালের এক বড় ডাক্তার নাকি বলেছে আমার বাম হাত কেটে ফেলতে হবে। আর পিঠসহ সারা শরীরে স্প্রিন্টার লেগে আছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই হাসপাতালে আমার চিকিৎসা করা হয়েছে। সম্ভবত দেশ স্বাধীনের ১২-১৩ দিন পর আমার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়, আপনার মেয়ে এখন কিছুটা সুস্থ। দেশে নিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে আরো কিছুদিন রাখলে ভালো হয়ে যাবে।
দুদিন পর অনেকের সহযোগিতায় আমাকে আগরতলা থেকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়। এখানে কত দিন ছিলাম মনে নেই। এক সময় বাড়ি ফিরে যাই। সারা জীবনের জন্য আমার বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়। অমাবস্যা, পূর্ণিমা এলে সারা শরীর জ্বালা-পোড়া করে। কিছুদিন পরপর ডাক্তার দেখাতে হয়। এমনিতেই তিন বেলা খেতে পারি না, তার ওপর ডাক্তার দেখাব কী করে। আলেয়া বিবি বলেন, আমি বিশ্বাস করি সরকার যদি আমার কথা শুনে তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবে।’
আলেয়া বিবি জানান, ‘হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর অনেকেই আমার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর আচরণ নিয়ে মাঝে মাঝে নানা কথা বলত। এ জন্য অনেকেই আমাকে বিয়ে করতে চাইত না। ১৯৭৮ সালে ব্রাহ্মণপাড়ার সদর ইউনিয়নের নাইঘর গ্রামে বর্তমান স্বামীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বর্তমানে আমার ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে আছে।’
বঞ্চনার শিকার এই মা বলেন, ‘পাকবাহিনীর হাতে আমি যে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছি তার অভিশপ্ত দাগ আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে, আজও আমাকে কেউ স্মরণ করল না। সরকার বিভিন্ন জনকে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও আমি সেই স্বীকৃতি পেলাম না। গরিবের মেয়ে ছিলাম, এখন গরিবের বউ। কেউ আমার খোঁজ নিতে আসে না। আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে আমার দাদা ও চাচি পাকবাহিনীর হাতে জীবন দিল। এই ৪৫ বছরে কেউ খবর নিল না। কোনো পত্রপত্রিকায়ও আমাকে নিয়ে খবর হলো না। এত দিন কারো কাছে প্রকাশ করিনি ক্ষোভে, লজ্জায় এবং দুঃখে। তখন নাকি ডাক্তাররা বলেছিলেন, বয়স বাড়লে নানা সমস্যা দেখা দেবে। আমার স্বামী এখন কাজও করতে পারছেন না। ছেলে দুজন দিন আনে দিন খায়। ৩ মেয়ের মধ্যে ২ জনকে বিয়ে দিয়েছি।
আলেয়ার স্বামী মো. ইউনুছ মিয়া বলেন, ‘সেদিন অনেকেই আমাকে পাকবাহিনীর কথা বলে তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি তাদের কথা শুনিনি। আমি বলেছি অন্যায় যদি করে থাকে পাক হানাদাররা করেছে, এই মেয়ের তো কোনো দোষ ছিল না। তাকে বিয়ে করে তার শারীরিক অবস্থার কারণে আমার সংসার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও আমি কোনো দিন তাকে কিছু বলিনি এ জন্য যে, যেহেতু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার কোনো অবদান ছিল না তাই একজন যুদ্ধাহত বীরাঙ্গনা মহিলাকে বিয়ে করে আমার মতো একজন গরিব কৃষক কিছুটা হলেও ঋণ শোধ করলাম।
আলেয়া জানান, তার বাবার নাম আবদুল কাদের, মাতা শামসুন নাহার। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা ছিলেন একজন সামান্য কৃষক।
আলেয়ার ছোট একটি ঘর। ওই ঘরটিতে কোনোমতে থাকেন। জীর্ণ ঘরটির মতো তার শরীরও জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়েছে। ওই ভঙ্গুর শরীরে ১৯৭১ সালের পাকবাহিনীর নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন তিনি। কথা বলার সময় কিছুটা জড়তা কাজ করছে। কিন্তু স্মরণশক্তিটা তার লোপ পায়নি।
তিনি জানান, ‘প্রথম দিকে ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এলে আমাকে ডাকা হতো। বিচ্ছিন্নভাবে কিছুটা সহযোগিতাও পেয়েছিলাম। কিন্তু তা খুবই সামান্য। এর পর আবার সবাই ভুলে গেল। বর্তমানে আমার স্বামী অসুস্থ। ছেলেটা বেকার। ঘরে মেয়ে আছে। ছোট একটি ঘর। কী খাই, কী পরি, কোথায় থাকি এ চিন্তা করতে করতেই যাচ্ছে জীবনটা। তবে এবার প্রথমবারের মতো কুমিল্লার ডিসি সাহেব আমাদের শহরে নিয়ে, অনুষ্ঠান করে জমি দিয়েছেন। ওইখানে গিয়ে দেখি আমার মতো আরো ১৩-১৪ জন আছেন। সবাই আমাদের নিয়ে যেভাবে কথা বলেছে, তা শুনে কান্না এসে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম ’৭১-এর যন্ত্রণা। স্বামীকে বাড়ি আসতে আসতে বলেছিলাম, এবার আমার ওষুধের জন্য আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। সরকার যে জমি দিয়েছে আপনে আর আপনের ছেলে মিলে এই জমি আবাদ করলে মোটামুটি ৩ বেলা না হলেও ২ বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারবেন। কিন্তু এখন আমার সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে। কারণ যে জমি পেয়েছি তা আমার কোনো কাজে আসছে না। সারা বছর পানিতে ডুবে থাকে। এটা একটু ভেবে দেখলে উপকৃত হব।’
আলেয়া বিবি বলেন, এত দিন শুনে এসেছি সরকার ঢাকা থেকে আমাগো বীরাঙ্গনা উপাধি দেবে। এতে আমরা ভালোভাবে বাঁচতে পারব, খেতে পারব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব কিছুই আওয়াজ। এখন আর উপাধি চাই না। সরকার যেন আমাদের তিন বেলা ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।