প্রতিবেদন

বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসব সুরের অবগাহনে মগ্ন ৫ রজনী

কর্মব্যস্ত ঢাকার ক্লান্ত নাগরিকদের গীত সুধারসে ভাসাতে গত ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় স্কয়ার নিবেদিত বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব। পাঁচ দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান চলে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত।
এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। গতবার আয়োজনের চতুর্থ দিনে, ৩০ নভেম্বরের অনুষ্ঠানে মঞ্চেই হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন এই শিল্পী। পরদিন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ঘোষণা দেন, পরের উৎসবটি হবে কাইয়ুম চৌধুরীর নামে। শ্রোতার সংখ্যার বিচারে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। অন্যবারের মতো এবার উৎসব প্রাঙ্গণে নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এবারই প্রথম ৬টি জুটি উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। এদের কেউ বাবা-ছেলে বা বাবা-মেয়ে, কেউ স্বামী-স্ত্রী, কেউবা গুরু-শিষ্য। কেউ আলাদা করে, কেউ একসাথে ওঠেন মঞ্চে। কণ্ঠসংগীতে গত সব আসরের মতো এবারও ছিল কৌশিকী চক্রবর্তী ও তার পিতা প-িত অজয় চক্রবর্তী। সন্তুরের সুরে দর্শকদের মোহিত করেন রাহুল শর্মা ও তার পিতা শিবকুমার শর্মা। দুই ভাই গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপাল শোনান কর্নাটকি বেহালা। প-িত উলহাস কশলকরের সাথে তার পুত্র সামিহান কশলকর এবার প্রথমবারের মতো সংগীত পরিবেশন করেন। অসাধারণ তার কণ্ঠ। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুর অন্যসব বারের মতো এবারও দর্শক শুনেছেন, সাথে ছিলেন তার শিষ্য জয়াপ্রদা রামামূর্তিও কর্নাটকি বাঁশি। আর শাস্ত্রীয় কুচিপুরি নৃত্য দিয়ে মঞ্চ মাতান গুরু রাজা রেড্ডি ও তার স্ত্রী রাধা রেড্ডি।
এ ছাড়া এবারই প্রথমবারের মতো উৎসবে যোগ দিচ্ছেন ওস্তাদ জাকির হোসেন, বিদুষী শুভা মুদগাল, অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী ও পদ্মবিভূষণ প-িত বালমুরালী কৃষ্ণ। এবার প্রথমবারের মতো সরস্বতী বীণা শুনেছেন ঢাকার দর্শক, শুনিয়েছেন জয়ন্তী কুমারেশ। এ¯্রাজে শুভায়ু সেন মজুমদার ও সুরবাহারে ছিলেন ওস্তাদ ইরশাদ খান। ওস্তাদ সুজাত খানের সেতার ও ওস্তাদ রশিদ খানের কণ্ঠসংগীত শোনার সুযোগ হয়েছে উৎসবে। এ ছাড়া এবার মৃদঙ্গমে ছিলেন গুরু করাইকুড়ি মণি, সেতারে প-িত কুশল দাস, সরোদে প-িত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার ও ওস্তাদ ইউসুফ খান, ধ্রুপদে প-িত উদয় ভাওয়ালকর ও ওস্তাদ ওয়াসিফউদ্দিন ডাগর, তবলায় প-িত সুরেশ তালওয়ালকর, বেহালায় এন রাজম ও কণ্ঠে শ্রুতি সাদোলিকর। ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন বিদুষী আলারমেল ভেল্লি।
বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে এবার মঞ্চে ছিলেন পল্লবী ড্যান্স থিয়েটারের শিল্পীরা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষালয় পরম্পরা সংগীতালয়ের শিল্পীরা তবলায় পরিবেশন করেন কীর্তন। এ প্রতিষ্ঠানের শিল্পী অভিজিৎ কু-ু ও সুস্মিতা দেবনাথও পরিবেশন করেন সংগীত। এ ছাড়া ওয়ার্দা রিহাব তার দল নিয়ে মণিপুরি নৃত্য পরিবেশন করেন। ধামার পরিবেশন করেন অনিমেষ চৌধুরী ও তার দল।
উৎসবের উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন।

নতুন প্রত্যয়ের অনুভূতি নিয়ে শেষ হলো ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’
অগ্রহায়ণের মিষ্টি সকাল। গত ২১ নভেম্বর। শনিবার সকাল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বর্ধমান হাউসের পাশের একটি মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। নাটকের কাহিনি হচ্ছেÑ “একজন পাঠকের অচেনা এক শহর থেকে সাইকেলে চেপে ‘ঢাকা লিট ফেস্টে’ আসার। এই আসার পথে সে নানা রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।” লিট ফেস্টের শেষ দিনের অনুভূতিও ছিল তেমনি এক আনন্দের, নতুন প্রত্যয়ের। বাংলাদেশের সাহিত্যের সাথে ইংরেজি ভাষার পাঠক-লেখকদের মেলবন্ধনের এক অনন্য আয়োজন ছিল ঢাকা লিট ফেস্ট। ১৯ থেকে ২১ নভেম্বর তিন দিনে বিভিন্ন সেশনে দেশি-বিদেশি লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সমালোচকদের আলোচনায়, আড্ডায় মুখর হয়ে উঠেছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। আগামী বছর আরও বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রত্যাশা জানিয়ে শেষ হয়েছে এবারের লিট ফেস্ট।
প্রথম দিনের মতোই শেষ দিনে আপন ভাবনার কথা বলেছেন ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা সায়গল। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আত্মীয়া এদিন রাজনীতির সাথে নিজস্ব লেখালেখির সম্পর্ক এবং ভারতের উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ চলমান নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বসে সাহিত্য নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা। তাতে ‘সবার জন্য সাহিত্য’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ভারতের কবি ও সাংবাদিক পৌলমী সেনগুপ্ত, কবি আতা সরকার, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও আন্দালীব রাশদী। ঘরোয়া আড্ডার ভঙ্গিমায় তারা তুলে ধরেন সাহিত্যের নানা দিক। স্বনামধন্য কবিদের অংশগ্রহণে দুপুরে একাডেমির বর্ধমান হাউসে বসে কবিতা পাঠের আসর। শামীম রেজার সঞ্চালনায় এই অধিবেশনের বিভিন্ন কবিতা পাঠ করেন মুহম্মদ নুরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, কামাল চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ ও ভারতের কবি চিন্ময় গুহ। নিজের কবিতা ছাড়াও বিদেশি কবিদের কবিতা পাঠ করেন তারা।
২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য, জাতীয়তাবোধ, ৬-দফা, সত্তরের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণা করে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। বললেন, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছিল। তবে তিনি বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী। ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর দ্বিতীয় দিনে নিজের লেখা বই আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস : দ্য ইয়ারস অব ফুলফিলমেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘দ্য মার্চ টু ইনডিপেনডেন্স’ শীর্ষক অধিবেশন সঞ্চালনা করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিসংবাদী নেতা। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে কাজ করেছিলেন রেহমান সোবহান। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর সকালেই মুখর হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি প্রান্তর। ঘাসফড়িং স্কয়ারের মুখরিত সুরে শুরু হয় উৎসব। সুরের রেশ ধরে মূল মঞ্চে ওঠেন ঢাকা লিট ফেস্ট-২০১৫ এর তিন পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ, সাদাফ সায্ সিদ্দিক এবং আহসান আকবার। তাদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের নতুন দিগন্তের বার্তা শোনা গেল বহুকণ্ঠে। জনপ্রিয় ভারতীয় সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ নয়নতারা সেগাল। তিনি উৎসবের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি বক্তব্যে ভারতের বর্তমান সাহিত্য চর্চার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদ’-এর সমালোচনায় সাহিত্যিকরা যে সম্মাননা ও পুরস্কার বর্জন করছেন তার সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, কীভাবে বর্জন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠতে পারে। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বক্তব্য রাখেন।

দর্শক-শ্রোতাদের মন মাতালো ঢাকা ফোক উৎসব
বাংলার লোকসংগীতের সাথে বিদেশি লোকসংগীতের সেতুবন্ধ, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লোকসংগীতের ঐতিহ্যে উদ্ভাসিত করার প্রত্যয়কে ধারণ করে গত ১৪ নভেম্বর শেষ হয় তিন রাতের ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট, আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব ২০১৫’। আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই উৎসবের সমাপনীতে সুরের মধু ছড়ান পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়িকা আবিদা পারভীন। সুরের সেই মধু আকণ্ঠ পান করেন উপস্থিত অর্ধলাখ সুর পাগল। আবিদার সুরের রশ্মিতে অবগাহন করে নৃত্যের ঝড় তোলেন সংগীতানুরাগীরা। মেরিল নিবেদিত প্রথমবারের মতো তিন রাতের এই লোকসংগীত আসরের আয়োজন করে মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস। ‘আলী আলী মাওলা মাওলা’ গানটি দিয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই শিল্পী তার পরিবেশনা শুরু করেন। ক্ল্যাসিক্যাল, রাগ ও বিটের অসাধারণ নৈপুণ্যে সংগীতের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন পাকিস্তানি এই শিল্পী। এর আগে সন্ধ্যায় জনপ্রিয় ফোক ফিউশন ব্যান্ড ‘জলের গান’-এর মন মাতানো পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সংগীতের এই মহা আসর। জীবনের ছবি ও বাঙালির স্বাভাবিক জীবনযাপনের ছবিগুলো ভেসে ওঠে জলের গানের পরিবেশনায়। জনপ্রিয় এই গানের দলটি এ সময় পরিবেশন করে ‘শুঁয়া যাও যাও গো যাওরে তেপান্তর’, ‘বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি’, ‘এই পাগলের ভালোবাসাটুকু নিও’, ‘আমি একটা পাতার ছবি আঁকি’। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত গান ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে জলের গান। এরপর মঞ্চে আসেন আয়ারল্যান্ডের শিল্পী নিয়াভ নি কারার। বেহালা, অ্যাকুস্টিক গিটার ও ড্রামসের সুরে তারা আইরিশ লোকজ সংগীতের একটি ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়ে শুরু করেন। ইংরেজি গানের পাশাপাশি আইরিশ ভাষায়ও গান পরিবেশন করেন তারা। পরে মঞ্চে আসেন দক্ষিণ ভারতের শিল্পী ইন্ডিয়ান ওশিন ও রাজস্থানের শিল্পী ম্যাঙ্গানিয়ার। প্রথম রাতে সংগীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের ফরিদা পারভীন, চন্দনা মজুমদার, কিরণ চন্দ্র রায়, লাবিক কামাল গৌরব, শফি ম-ল, ভারতের পাপন অ্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, অর্ক মুখার্র্জি কালেক্টিভ ও পাকিস্তানের সাঁই জহুর। দ্বিতীয় রাতের আসরে সংগীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের বাউল ভজন ক্ষ্যাপা, বারী সিদ্দিকী, আয়েশা জেবীন দিপা, বিউটি খাতুন, দিতি সরকার, মরিয়ম আখতার কণা, মাসুমা সুলতানা সাথী, আবদুল আলীমের তিন সন্তান আজগর আলীম, জহির আলীম, নূরজাহান আলীম, মমতাজ, অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, ভারতের পবন দাস বাউল ও ইউনান আর্ট ট্রুপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *