ভাষা আন্দোলনের শিল্পিত দলিল

লেখক: রফিকউল্লাহ খান
তারিখ: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

যে অবিস্মরণীয় ঘটনা ও তার পরিণাম বাঙালির জাতীয় জীবনে অক্ষয় প্রেরণা-উত্স হিসেবে বিদ্যমান, তা হলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। এই একুশের মূল্যবোধ ও চেতনা জনজীবনে সঞ্চার করার সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন হাসান হাফিজুর রহমান। সৃষ্টিশীল প্রতিভার কর্মোদ্যোগ ও আয়োজনে তিনি সম্পাদন করেছিলেন এই অসামান্য জাতীয় দায়িত্ব। কোনো যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পৃক্তিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আন্দোলনের প্রেরণাদায়ী দার্শনিক হিসেবে কিংবা নেতৃত্বদানকারী হিসেবে অথবা ঘটনার সমান্তরাল সক্রিয় কর্মী হিসেবে। কিন্তু বাঙালির ভাষা আন্দোলন কোনো ব্যক্তিপ্রতিভার এক উদ্যোগে যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি এর পরিণতি ও প্রেরণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টির যৌথ সংগ্রামের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর যে অবিনাশী সদর্থক চেতনার ভিত্তিতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও পরিণতি, তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক তাত্পর্য গভীর ও সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ, ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চূড়ান্ত ও রক্তক্ষয়ী প্রকাশ; ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের পরাজয়, ১৯৫৮ সালে সেনাতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের প্রবর্তন, ষাটের দশকব্যাপী ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বাঙালি জাতিকে কয়েক শতাব্দীর জীবনী শক্তিকে ২৩ বছর সময়সীমার মধ্যে ব্যয় করতে হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত উপকরণসমূহ প্রবল স্রোতাবেগে সমগ্র জনগোষ্ঠীকেই আন্দোলিত ও সম্মুখগামী করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষফল ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির অসারত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—প্রথম পর্যায়ের নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা অতিদ্রুত সকল স্তরের মানুষকেই আন্দোলনের অংশে পরিণত করতে সক্ষম হয়। যৌথ চেতনা, যৌথ জীবনাবেগ ও সম্মিলিত সংগ্রামের এই নবজাগরণতুল্য আয়োজনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রেও ঘটে যায় বড় ধরনের যুগান্তর। এই যুগান্তর ও বিপ্লবকালের কর্মী ও শিল্পীপুরুষ ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৫২ সালে তাঁর বয়স ছিল বয়স ২০ বছর। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের এম.এ. শ্রেণির ছাত্র।

প্রথম ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন সম্পাদনার ক্ষেত্রে হাসান হাফিজুর রহমানের ভূমিকা কতোটা অগ্রণী ছিলো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সংকলনের প্রকাশক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মীপুরুষ মোহাম্মদ সুলতানের ভাষ্য থেকে :
‘তেপ্পান্ন সালের প্রথম দিকে হাসান প্রস্তাব দিল ৫২-ও উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখক সমাজ কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকাকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। আজকের দিনে অনেকেই ভাবতে পারেন, কাজটি কত সহজ। মুসলিম লীগের শাসন, চতুর্দিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, বামপন্থী মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী, পূর্ব পাকিস্তানি তরুণদের আর্থিক অসচ্ছলতা, সরকারের গণবিরোধী শাসনের স্টিম রোলার— সব কিছুকে অস্বীকার করেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করতে হবে। আমরা যারা রাজনীতি করতাম, ৮ পয়সা থেকে ১২ পয়সা পেলে রাজভোগ খাওয়া হত মনে করতাম। সেই সময়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটা বের করতে সেই মুহূর্তেই ৫০০.০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা, যা চিন্তা, হাসান তাই করল।’ (রহমান ১৯৮৩ : ৬২-৬৩)

এই দায়বদ্ধতা যে প্রেরণা থেকে উত্সারিত, তার সাংস্কৃতিক শেকড় হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রামশীল ও আত্মত্যাগী চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত।

১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন প্রকাশিত হয় এবং তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের শিল্পিত আবেগপুঞ্জকে সংরক্ষিত করার এই কর্মোদ্যোগ, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ হাসান হাফিজুর রহমানের জীবনচেতনার এক গৌরবোজ্জল প্রান্ত। জাতীয় ইতিহাসের এক মহত্তম অধ্যায়ের রক্তাক্ত অনুভূতিপুঞ্জকে গ্রন্থবদ্ধ করে বাঙালি জাতির জীবন ও শিল্পচেতনার পটভূমিতে তিনি মর্যাদার স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পৃক্তি কেবল প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শিল্পিত আবেগে, সৃষ্টিশীলতার যুগান্তকারী প্রকাশে এবং সাংগঠনিক কর্মপ্রক্রিয়ায় হয়ে উঠেছিল প্রাণচঞ্চল ও গৌরবময়। তাঁর জীবন ও শিল্পবোধের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠেছিল নবমাত্রিক সৃজনপ্রেরণার বীজশক্তি। ব্যক্তিবোধের সঙ্গে সমষ্টি-আবেগের এরূপ সমন্বয় আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে বিরল। তাঁর নিজ উচ্চারণের মধ্যেই এ বিবেচনার স্বীকৃতি বিদ্যমান:
“১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছেলে-মেয়েই জড়িত ছিলো। Sensation সবারই সমান ছিলো। যেহেতু আমি সাহিত্যিক ছিলাম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলাম — সেজন্য কোনো কিছু করার অবকাশ আমার বেশি ছিলো।
একুশে ফেব্রুয়ারীতে আমি এবং অলি আহাদ মধুর কেন্টিনে বসে ছিলাম। …আমি গিয়ে তাদের নিষেধ করলাম, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। কতক্ষণ পর দেখলাম, আমি নিজেও ইট মারতে শুরু করেছি। তারপর একটা টিয়ার শেল আমার কাছে পড়লো, কিন্তু সেটা ফাটেনি। আমি সেটা ঘুরিয়ে উল্টাদিকে মারলাম, তিন চার হাত দূরে সেটা পড়লো।
তারপর তিন/চার মিনিট পরে গুলি চললো। কারা করছে বুঝতে পারলাম না। বরকত ব্যারাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার থাই ভেদ করে গুলি চলে গেলো। লম্বা মানুষ। বসে থাকলেও গুলি তার মাথায় লাগতো। আমি এবং বরকত একসাথেই অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম, Political science-এ। বেশ লম্বা, ছয় ফিট তিন ইঞ্চি, খুব চুপচাপ থাকতো। তার রাজনীতিসম্পৃক্তি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি তখন গেটে — যখন বরকত গুলিবিদ্ধ হলো। গুলি আড়াইটায় হয়েছিলো। আমি বরকতের ডেডবডি দেখিনি।
‘অমর একুশে’ কবিতাটি আমি ১৯৫২-র মার্চ/এপ্রিলের দিকে লিখি। জুন মাসে কুমিল্লা সাহিত্য সম্মিলনে প্রথম জনসম্মুখে পাঠ করি। আমার সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনেই সেটা প্রথম ছাপা হয়।” ( খান ২০০৭ : ৩৩-৩৪)

সৃজনশীলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার এই সংযুক্তি হাসান হাফিজুর রহমানের আমৃত্যুর সাধনায় পরিণত হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-সচেতন বাঙালির আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের স্মারক। সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসকাররা বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে এই ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া বাঙালির সৃষ্টিশীল চেতনায় যে সংরক্ত আবেগ ও প্রেরণা সঞ্চার করেছিল, তাকে প্রথম গ্রন্থরূপ দিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন। প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পুঁথিপত্র প্রকাশনী। সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া কিভাবে বাঙ্ময় রূপ লাভ করেছিল, সংকলনভুক্ত রচনাসমূহ তার প্রমাণ। যুগান্তরের সম্ভাবনাদীপ্ত ভাষা আন্দোলন কেবল বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার প্রগতিপন্থাকেই নির্দেশ করেনি, জাতির পরবর্তী প্রতিটি সংগ্রাম ও সাফল্যেরও প্রেরণা-উত্স হয়ে উঠেছে। সংকলনের ভূমিকায় ব্যক্ত হয়েছে উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিপীড়িত সমাজমানসের আত্ম-আবিষ্কারের মূলধ্বনি:
‘শুধু পাক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়া জোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।’

‘মেকী আজাদী’র অন্তর্গত ‘নিরক্ত অন্ধকার কালো বিভীষিকা’ জাতীয় জীবনে যে অবক্ষয় ও হতাশা সৃষ্টি করেছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তিম প্রতিবাদের অগ্নিশিখায় তা অপসারণ করে। বাঙালির চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের দীক্ষা প্রসঙ্গে ভূমিকায় বলা হয় : ‘একুশে ফেব্রুয়ারী দেখিয়েছে জনতার সকল শ্রেণীর প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে প্রতিক্রিয়ার সকল ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করা সম্ভব।’ অনমনীয় মনোবল, মীমাংসিত রাজনৈতিক দর্শন ও অপরিমেয় জীবনী শক্তি ছাড়া এ ধরনের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ সম্ভব নয়। সংকলনভুক্ত রচনাগুলোর মধ্যেও ব্যক্ত হয়েছে জাতির নবজাগরণের অন্তঃস্বর।

লেখক : রফিকউল্লাহ খান, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

%d bloggers like this: