ভাষা আন্দোলন>>Language Movement
পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোয় মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য বাঙালি ছিল বিশ্বের প্রথম জীবনদানকারী জাতি। ভাষা আন্দোলনকে মোটা দাগে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়টি প্রাক্ পাকিস্তান আমল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৫১-৫২ সাল অবধি। তবে ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আওয়াজ ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আর এরই অনুষঙ্গ হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার একটা মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সারা পাকিস্তানের জন্য চালু করা নতুন মুদ্রা (টাকা), ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, দলিল-দস্তাবেজ, রেলের টিকিট প্রভৃতি সব কিছুতেই মূলত উর্দু ও ইংরেজি লেখা হয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর প্রস্তাব করা হয়। ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ‘আরবি হরফে’ বাংলা লেখার প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না সরকারি অর্থ খরচ করে ‘আরবি হরফে’ লেখা বাংলা বই বিনামূল্যে প্রচার এবং এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেন।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ঢাকায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কেবল উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের ভাষা করার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার এই সংশোধনী প্রস্তাবটি মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে অগ্রাহ্য হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
তমদ্দুন মজলিস প্রভাবিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারায় ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে নতুন করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ (১৯৪৮) সমগ্র পূর্ববাংলায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসে সচিবালয়ের প্রথম গেটের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভ মিছিল থেকে পুলিশ শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদ ও কাজী গোলাম মাহাবুব প্রমুখ নেতাকে গ্রেফতার করে। মিছিলে ব্যাপক লাঠিচার্জ ও পুলিশি নির্যাতন করা হয়। গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৩ মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। মার্চ মাসের মধ্যেই ভাষা আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হটে। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি করেন। তমদ্দুন মজলিস একে বিরাট বিজয় হিসেবে দেখলেও সাধারণ ছাত্ররা চুক্তিতে খুশি হয়নি। ফলে ১৬ মার্চ সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ দফা চুক্তির প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবন অবরোধ করে। পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে অবরোধ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় প্রথমবার এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এই উক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের ছাত্রদের মধ্য থেকে ঘড় ঘড় ধ্বনি ওঠে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৫০ সালে নতুন করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশ থেকে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ভাষা আন্দোলনে প্রাণসঞ্চরের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আন্দোলনে ছেদ ঘটায়। তবে ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তাদের বহুমুখী রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রচারমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে ভাষার প্রশ্নটিকে পূর্ববাংলার রাজনীতির প্রধান ইস্যুতে পরিণত করতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টরেন আয়োজিত জনস্যভায় পুনরায় উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ৩১ জানুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ’। মওলানা ভাসানী এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ঐ দিন ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। ছাত্রদের পরিকল্পনা ছিল ওই দিন মিছিল করে ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষার দাবি জানানো। সরকার শঙ্কিত হয়ে শহরে ১৪৪ ধারা জারি ও মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্ররা সমবেত হয়। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্রসমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের হয়। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী মিছিলের ওপর গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার প্রমুখ ছাত্র তরুণ। অসংখ্য ছাত্র আহত ও গ্রেফতার হন। ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন থেকে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আনোয়ারা বেগম ও আবুল কালাম শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন পরিষদ সদস্য ওয়াকআউট করে বেরিয়ে আসেন। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হয়। ছাত্র আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববাংলা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।