মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ বরণ একটি প্রাণের উৎসব। সকলে মিলেমিশে বাংলা বর্ষকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ ধরে অপেক্ষা করে থাকে এ দেশের মানুষ। আর বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষজ্ঞ মঙ্গল শোভাযাত্রা। সম্প্রতি এটি পেয়েছে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক এই সংস্থা ৩০ নভেম্বর ২০১৬ আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্বীকৃতির কথা জানিয়েছে। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় আন্তঃদেশীয় কমিটির একাদশ বৈঠকে ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অব ইন্ট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটি’র তালিকায় বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত হয়। এবারের সভায় বাংলাদেশ ছাড়াও ইউক্রেন, কম্বোডিয়া, কিউবা, স্পেন, আফগানিস্তান, বেলজিয়াম ও উগান্ডার একটি করে মোট ১০টি উৎসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে জামদানি শাড়ি ও ২০০৮ সালে বাউলসংগীত ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি তুলনামূলকভাবে নতুন বর্ষবরণ উৎসব। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এটি প্রবর্তিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এ ছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে প্রায় প্রতি জেলা সদরে এবং বেশ কিছু উপজেলা সদরে পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আয়োজিত হওয়ায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বাংলাদেশের নবতর সার্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
শোভাযাত্রার শুরুর কথা
মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আগেই শুরু হয়েছিল যশোরে। যশোরে শিল্পী এসএম সুলতানের অনুপ্রেরণায় কয়েকজন তরুণ চারুশিল্পী গড়ে তোলেন চারুপীঠ। উদ্দেশ্য শিশুদের চারুশিল্পে শিক্ষাদান। চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল হাসিব। যশোরবাসীর সহযোগিতায় তিনি গড়ে তোলেন এই প্রতিষ্ঠান। সার্বক্ষণিক সঙ্গী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পাস করা দুই তরুণ শিল্পী মাহবুব জামিল আর হিরণ¥য় চন্দ। তাদের মাথায় এসেছিলÑ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ সবার আলাদা উৎসব আছে; কিন্তু এমন একটি উৎসব চাই, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজের অনুষ্ঠান মনে করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। চারুপীঠ যশোরে ১৯৮৫ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। সার্বিক সমন্বয়ের কাজ করেছিল যশোরের অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যশোর ইনস্টিটিউট। সেই শোভাযাত্রায় শামিল হয় সব সংগঠন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রা পেল সার্বজনীনতার মর্যাদা।
ঢাকায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা
১৯৮৯ সালে ঢাকায় পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চারুকলা থেকে পাস করা শিল্পীদের সংগঠন চারুশিল্পী সংসদের সাথে তৎকালীন ছাত্ররাও যুক্ত হয়। চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি ছিলেন রফিকুন নবী। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও এগিয়ে আসে। প্রথমে এর নামকরণের কথা ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা। আলাপ-আলোচনার পর ঠিক করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটিই থাকবে। প্রথম বছর শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা হয় ১০টি ছোট ঘোড়া আর বিশাল হাতি। ৫০টি মুখোশ তৈরি করা হয়েছিল। তখন দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চলছিল। শোভাযাত্রায় রাক্ষসকে স্বৈরশাসকের প্রতিরূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। শোভাযাত্রার শুরুতে লোক সমাগম কম ছিল। কিন্তু অল্প পরেই সেটা একটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এখন প্রতিবছরই বৈশাখের প্রথম দিনে হয়ে আসছে প্রাণের উৎসব মঙ্গল শোভাযাত্রা। চৈত্রের প্রথম থেকেই শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। প্রতিবছর চারুকলার মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা এই শোভাযাত্রার বড় কাজটা করে। সাথে যোগ দেয় পুরনো অনেকেই।
মঙ্গল শোভাযাত্রার বিবর্তন
১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ সালের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং-বেরঙের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।
ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ২০০৩ সালে ইউনেস্কো একটি সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন করে। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এখন পর্যন্ত ১৭০টিরও বেশি রাষ্ট্র ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। নিয়ম অনুযায়ী এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো প্রতিবছর মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যে কোনো একটি উপাদানকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের জন্য আবেদন করতে পারে। নানা যাচাই-বাছাইয়ের পর ইউনেস্কো কোনো দেশের সাংস্কৃতিক উপাদানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার ফলে বিশেষ সাংস্কৃতিক উপাদানটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতিই পায় না, অন্যান্য দেশের মানুষকেও এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে।
আবেদন প্রক্রিয়া
মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করে বাংলা একাডেমি। এর জন্য অনুমতি নিয়েছিল সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের। ইউনেস্কোর সভায় ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন ও মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা নিসার হোসেন এবং ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ফারহানা হোসেন উপস্থিত ছিলেন। তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য করার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।
ইউনেস্কোর ভাষ্য
ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি তার ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস। ইউনেস্কো বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বের হয় এই শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণরা এটি শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা বের করে। ইউনেস্কো আরও বলছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক।
পর্যটনের জন্য মঙ্গলবার্তা
দেশের অগ্রসরমান পর্যটন শিল্পে মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একটি বড় অর্জন। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতিতে দেশের বর্ষবরণের আয়োজন এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ট্যুরিস্ট প্রোডাক্ট হলো। বাংলাদেশে বেড়াতে আসা বিদেশিদের জন্য নিঃসন্দেহে এই সংবাদ বাড়তি আকর্ষণ জোগাবে। এখন আমাদের মূল কাজ হলো এই অর্জনকে দেশের বাইরে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা। এজন্য সভা-সেমিনার, ভ্রমণ নিয়ে প্রকাশিত পুস্তিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্ণিল আনন্দকে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের টানে বছরে একবারের জন্য হলেও দেশে নিয়ে আসার একটা উপলক্ষ্য হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
পরিশেষে, সামরিক স্বৈরাচারের সময় প্রতিবাদের ভাষা ও শুভবোধের সংকল্প থেকে যে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল, আজও সবরকম ভেদাভেদ ও অন্যায়ের বিরোধিতার ঐতিহ্য তা ধারণ করে আছে। এর মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির উদার মানবিক বার্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। ইউনেস্কোর এই তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা আশা রাখি। প্রত্যাশা করি, সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা বজায় রাখার পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক ধারাকে আরও বেগবান করতে বরাবরের মতো সময়োচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।