তত্ত্ব তথ্য ইতিহাস

মহাভারত ও রামায়ণ

মহাভারত ও রামায়ণ ঠিক ধর্মগ্রন্থ নয়। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের মনে হাজার বছরের লালিত সংস্কার ও বিশ্বাসে এ দুটি মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থের স্থান দখল করে আছে। শুধু তাই নয়, এ দুটি মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র দুটিÑ শ্রীকৃষ্ণ ও রাম মানুষরূপী অবতাররূপে পূজিত। এ দুটি মহাকাব্যই গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে। তবে এ দুটি মহাকাব্যের মূল কাহিনি ও উপাখ্যানগুলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহ¯্রাব্দের প্রথমাংশে রচিত বলে মনে করা হয়। মহাভারত হচ্ছেÑ
The great epic poem of the Hindus, probably the longest in the world. It is divided into eighteen parvas or books, and contains about 2,20,000 lines. The poem has been subjected to much modification and has received numerous comparatively modern additions, but many of legends and stories are of Vedic Character and of great antiquity.
‘মহাভারত’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন : ‘আর্য সমাজে যত কিছু জনশ্রুতি খ- খ- আকারে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকেও একত্র করিয়া মহাভারত নামে সংকলিত হইল।’ মহাভারতের মূলকাহিনি পা-ব-কৌরবদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কেন্দ্র করে পল্লবিত হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে ১৮ দিনব্যাপী এক মহাসমরে পরিণতি লাভ করে।
রামায়ণ
সাধারণভাবে ‘রামায়ণ’ হচ্ছে বনবাসরত অযোধ্যার রাজা রামের সুন্দরী পতœী সীতা রাক্ষসরাজ রাবণ কর্তৃক অপহরণ এবং তাকে উদ্ধারের কাহিনিকাব্য। ‘মহাভারতে’র বন-পর্বে ‘রামায়ণে’র মূলকাহিনির উল্লেখ রয়েছে। ‘রামায়ণ’ সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীনতম দুই মহাকাব্যের অন্যতম। ধ্রুপদী ‘রামায়ণে’র রচয়িতা ঋষি বাল্মীকি। ‘রামায়ণে’র সবচেয়ে পরিচিত ভাষ্যগুলোর মধ্যে একটি উত্তর ভারতের অন্যটি বাংলা ভাষায় রচিতÑ
The Northern is the older and purer; the additions and alternations in that of Bengal are so numerious that it is not trustworthy, and has even been called Spurious.
বাংলা ভাষায় ‘রামায়ণ’ অনুবাদ করেন মধ্যযুগের কবি কৃত্তিবাস ওঝা (১৪০০-১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দ)। কৃত্তিবাসী রামায়ণ আক্ষরিক অনুবাদ তো নয়ই; বরং এটি বহুলাংশে মৌলিক রচনা। বাঙালি হিন্দুরা কার্যত কৃত্তিবাসী রামায়ণের দ্বারাই সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। উত্তর ভারতের সংস্কৃত ও হিন্দি ‘রামায়ণ’ ছাড়া ভারতের নানা প্রাদেশিক ভাষায়ও ‘রামায়ণ’ বিভিন্ন সময় অনূদিত হয়েছে। ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব ‘রামায়ণে’ (এমনকি ‘মহাভারত’ও) স্থানীয় অনুবাদক বা রচয়িতার হাতে পরিবর্তিত, সংযোজিত হয়েছে এবং স্থানীয় ভাষ্য হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাম-সীতা সম্পর্কে নানা লোককাহিনি-লোকগাঁথা।
শ্রীকৃষ্ণ ও রাম কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র কি না তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রতœতাত্ত্বিক বা অন্য কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রামাণ্য নিদর্শন পাওয়া যায় নি, যা থেকে রামচন্দ্রকে কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা যায়। হিন্দু মিথোলজি অনুসারে রামচন্দ্রও মানুষরূপী অবতার :  The Rama is the seventh incarnation of God Vishnu, and made his appearances in the world at the end of the Treta or second age.
এ কথা সত্য বটে, বাস্তব ঐতিহাসিক ব্যক্তিমানুষ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করেও মানব কল্পনাপ্রসূত মিথ গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ববিহীন ব্যক্তি এবং পৌরাণিক কাহিনিকাব্যকে ঘিরে যে মিথ গড়ে ওঠে, তাকে সাহিত্য হিসেবে গ্রহণ করা গেলেও, ইতিহাস হিসেবে অবশ্যই তা পরিত্যাজ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মৌলবাদীরা যুক্তির বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ধার ধারে না। তারা মিথকে হয় জাগতিক নয়তো ঐশ্বরিক সত্য বিবেচনা করে, সেই ‘সত্য প্রতিষ্ঠায়’ যে কোনো পথ গ্রহণে দ্বিধাহীন। উপমহাদেশে ‘হিন্দুত্ববাদী’ সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী শক্তিগুলো ‘রাম জন্মভূমি’ নিয়ে যে হিংসাশ্রয়ী ঘটনা (বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২) ঘটিয়েছে, তার প্রেরণার অন্যতম উৎস রামকাহিনি বা ‘রামায়ণ’। অথচ ‘রামায়ণে’ সূর্য বংশীয় রাজা রামচন্দ্রকে একজন ন্যায়পরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ, মানবহিতৈষী, প্রজাবৎসল এবং পরম ধার্মিক অতিমানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আধুনিক স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী এই রামরাজত্বকেই তার রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গান্ধীজী তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন পরম ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সেকুলার মানবতাবাদী। রামরাজত্বের ধারণাকে তিনি রূপক বা প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার কাছে রামও যে, রহিমও সে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীরা রামজন্মভূমি ও রামরাজত্বকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রচিন্তার আকর হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে বারংবার।
নূহ-উল-আলম লেনিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *