মার্চ মাসে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী মার্চ মাসে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত তিনটি মানদন্ড যথা- মাথাপিছু জিএনআই, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক সংকট সূচকের মান ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে।

তবে এই সুখবরের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ আরো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাংলাদেশের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতাও বাংলাদেশের রয়েছে। বরং উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হলে বিশ্বে সুনামের পাশাপাশি বিনিয়োগ, বাণিজ্যে নতুন কিছু সুবিধাও পাওয়া যাবে। বিনিয়োগে বিদেশীদের আস্থা বাড়বে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্¦ল হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) উদ্যোগে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের ‘এলডিসি অর্জনের চ্যালেঞ্জ ও সুবিধাসমূহ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম, বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মো. শাহারিয়ার আলম, বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মুনসুর প্রমুখ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী শফিকুল আযম বলেন, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের পর যেসব সমস্যা ও তৈরি হবে তা কাটিয়ে উঠতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী মার্চ মাসে জাতিসংঘের ত্রি-বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হবে। ওই সভায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রথম পর্যায়ের সুপারিশ লাভ করবে। তিনি জানান, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়ন দেশগুলো থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধাসহ নমনীয় হারে উন্নয়ন সহায়তা পেয়ে আসছে। এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের অনুকূলে এসব বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে।

তবে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা ও উত্তরণের ক্রান্তিকাল যাতে মসৃণ হয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, উন্নয়ন কর্মসূচী এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে যাতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় এজন্য এখন থেকে কার্যক্ষেত্রে নিবিড় সম্পৃক্ততা বজায় রাখা জরুরী হয়ে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের ধারবাহিকতায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত নির্ণায়ক তিনটি সূচকের মান ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়েছে। আশা করছি, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ন হওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সব ধরনের সক্ষমতা অর্জন করবে।

প্রসঙ্গত, ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকার পর বাংলাদেশ চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন অনেক মর্যাদার বলে মনে করা হচ্ছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের জন্য বিবেচ্য তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে এ দেশ এ স্বীকৃতি অর্জন করতে চলেছে। এর ফলে নতুন অবয়বে সারাবিশ্বের সামনে অভ্যুদয় ঘটবে বাংলাদেশের। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতি বিষয়ক কমিটি (সিডিপি) প্রতি তিন বছর অন্তর এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয় পর্যালোচনা করে। ইতোমধ্যে সংস্থাটি প্রাথমিক হিসাব করে নিশ্চিত করেছে, তাদের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় বাংলাদেশ আগামী মার্চে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার মানদন্ড পূরণ করবে। এরপর ২০২১ সালের পর্যালোচনায় সিডিপি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করবে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনুমোদন দেবে জাতিসংঘ। কোনো দেশ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটিতে পর পর দুটি পর্যালোচনায় (৬ বছর) উত্তীর্ণ হলে তাকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। বাংলাদেশই প্রথম এলডিসি যে, তিনটি সূচকেই শর্ত পূরণ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মার্চে যে পর্যালোচনা হবে, তাতে মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ ডলার। বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত এ্যাটলাস পদ্ধতিতে এ আয় নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘের ওই কমিটির হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১২৭২ ডলার। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ তথ্য মানব সম্পদ সূচকে স্কোর থাকতে হবে ৬৬ বা তার বেশি। বাংলাদেশের স্কোর এখন ৭২ দশমিক ৮। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের স্কোর হতে হবে ২৫ বা তার কম। বাংলাদেশের এই স্কোর এখন ২৫ এর বেশি। এ কারণে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী মার্চে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রথম স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি যেভাবে আছে, তার কোনো বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। এটি যেমন মর্যাদার তেমনি এর সঙ্গে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। দেখার বিষয়, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটা দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার সুবিধা পায় তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক ঋণে কম সুদ ও নমনীয় শর্তও সীমিত হয়ে আসবে। তবে এটা ঠিক, বড় বিষয় মর্যাদার। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি অর্জনের পর আন্তর্জাতিক ফোরামে তখন বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দেখতে হবে, এ দেশের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা রয়েছে।

ড. মশিউর রহমান রহমান বলেন, বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই স্বীকৃতি হবে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও রফতানিতে এখন যেসব বাণিজ্য সুবিধা রয়েছে তা বহাল রাখতে কৌশল নেয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে করুণীয় সবকিছু করা হবে। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসা যেকোন দেশের জন্য গর্বের। উন্নয়নশীল দেশের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা বিশ্বে বহাল রয়েছে তার পুরোটাই গ্রহণ করতে হবে। এটাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে করুনীয় নির্ধারণে কাজ শুরু করা হয়েছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, এ বছরে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি অনেক ইতিবাচক খবর। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। আরও বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ সুগম হবে। তবে উত্তরণের সব পর্যায়েই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। এগুলোর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি দ্রুত নিতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়। বাংলাদেশকে এ জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

Leave a Reply

%d bloggers like this: