বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামমুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

মিরপুরের মুক্তিদাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ লে. সেলিম

গতকাল ছিল মিরপুরের মুক্তিদাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ লে. সেলিমের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭২-এর এই দিনে মিরপুরকে মুক্ত করতে গিয়ে লে. সেলিমসহ ৪১ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য, শতাধিক পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে লে. সেলিমই যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্ত করেন অবরুদ্ধ মিরপুর। ৩০ জানুয়ারি ‘৭২-এর সারাটা দিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের শেষ রক্তবিন্দুটুকু ঝরিয়ে যুদ্ধ করে বিজয়ের পথ খুলে দেন সেলিম। এভাবেই ৩১ জানুয়ারি প্রভাতে মুক্ত হয় অবরুদ্ধ মিরপুর। এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নিখোঁজ হন। প্রকৃতপক্ষে এ অভিযান শুরু হয়েছিল বিশিষ্ট সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধান করতে গিয়ে।

বুকে বুলেটের আঘাত নিয়েও সম্মুখ সমরে লে. সেলিম যে অসাধারণ সাহসিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে গেছেন, তা তার সহযোদ্ধারাই বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। এই অসাধারণ বীর যোদ্ধা ও তাঁর ভাই লে. আনিস (ডা. এম. এ. হাসান) ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকার তেজগাঁওয়ে ১ প্লাটুন পুলিশ সদস্য নিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করেন, তা পরিণত সমরে রূপ নেয় ১৯৭১-এর ১৪ এপ্রিল লালপুর আশুগঞ্জে। ওই দিন সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে লে. সেলিম যে সাহসী সমর অভিযাত্রা শুরু করেন তা ‘৭১-এর ৯ মাসে কখনও থেমে থাকেনি। তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বারবার পরাভূত করেছেন লে. সেলিম। সিলেটের হরষপুর ও নোয়াখালীর বিলোনিয়া-পরশুরাম মুক্তকরণ অভিযানে তিনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডারের সহযোগী হিসেবে যুদ্ধ করেছেন। ৪ ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে লে. বদি শহিদ হলে লে. সেলিম দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আখাউড়া যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতার ৪১ দিন পর মুক্ত বাংলাদেশের বুকের কোণে অবরুদ্ধ মিরপুরে দলছুট পাকিস্তানি সেনাসহ আলবদর বাহিনী তথা বিহারি মুজাহিদ কর্তৃক আত্মসমর্পণ চুক্তি ও জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ করে বাঙালি সেনাদের ওপর ওই আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মাটিতে পরাভূত হওয়ার পরও এ দেশকে তাদের করায়ত্ত রাখার যে অশুভ পরিকল্পনা ও অভিলাষ পোষণ করছিল এবং বিজয়ীর প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করছিল; ওই দিন মিরপুরে সংঘটিত ঘটনা ছিল তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। সেলিম ও আনিস ভ্রাতৃদ্বয় পাকিস্তানের জন্য ত্রাস সৃষ্টি করে ভারতীয় মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কাড়েন। তাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করে এবিসি টেলিভিশন। জুলাইয়ের শেষে ভারতে যে ৬১ জন অফিসারকে ট্রেনিং দেওয়া হয়, তারা তাতে নির্বাচিত হন। এতে মেধা তালিকায় শীর্ষদের মধ্যে স্থান করে নেন সেলিম। অক্টোবরের ১৮ তারিখে ২য় ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দিয়ে সেলিম বিলোনিয়া যুদ্ধে শরিক হন।

সেলিম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রথম গার্ড কমান্ডার। ওই পদে থাকাকালে ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ অবরুদ্ধ মিরপুরকে মু্ক্ত করতে তাকে মিরপুরে নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান তথা দায়িত্বকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে একজন প্রকৃত বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হন লে. সেলিম।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পূর্বে তিনি রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে রুয়েট) অধ্যয়নরত ছিলেন। সেখানে তিনি কেবল একজন আপসহীন ছাত্রনেতাই ছিলেন না; সেইসঙ্গে একজন অসাধারণ অ্যাথলেট ও কৃতী খেলোয়াড় হিসেবে কলেজ ও বিভাগীয় পর্যায়ের অধিকাংশ ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
শহিদ লে. সেলিমের নামে কচুক্ষেত থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণের দাবি জানিয়েছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বের খেতাবে ভূষিত করাও সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *