মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ভাষাসংগ্রামী ইউনুস এমএলএ
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আমার দাদু আবু মুহাম্মদ ইউনুস আলী (ইউনুস এমএলএ) বঙ্গবন্ধুর ইসলামীয়া কলেজ লাইফের বন্ধু, বেকার হোস্টেলের রুমমেট ইউনুস এমএলএ আজীবন তাঁর প্রিয় বন্ধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা করে গিয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো তাঁর বন্ধু মুজিবের সংগঠন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক আদর্শের সঙ্গে বেঈমানী করেননি; বাঙলার এই মাটির নেতা ইউনুস এমএলএ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বেঁচে আছেন আদর্শবাদী শুভ-শক্তিরূপে।
১৯২১ সালে আবু মুহাম্মদ ইউনুস আলী পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ঐহিত্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, পাবনায় পড়াশুনার পাট চুকিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে বাঙলা বিভাগে ভর্তি হন, ইসলামীয়া কলেজের আবাসিক ছাত্র হিসেবে বেকার হোস্টেলে বসবাস করতে শুরু করেন তিনি, এখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে সেই সময়ের অবিভক্ত ভারতবর্ষের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে, একই রুমে থাকতে শুরু করেন তাঁরা; এখানে শুরু আবু মুহাম্মদ ইউনুস আলীর ছাত্র রাজনীতি। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতিকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন ইউনুস আলী।
১৯৪৩ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকারের দমনপীড়নের অংশ হিসেবে ভারতবর্ষে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কলকাতাজুড়ে ত্রাণের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে, এই সময়ে তাঁরা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের চাউলের গুদাম থেকে মজুদকৃত বস্তার পর বস্তা চাউল অভুক্ত মানুষের মধ্যে বণ্টনের জন্য সেখান থেকে আনতে শুরু করেন। এইসব মজুতদারেরা তখন দশ টাকা মণের চাউল পঞ্চাশ টাকা দরে বিক্রি করা শুরু করেছিলো সুযোগ বুঝে। তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগ সেই দুর্ভিক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও অন্যতম সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন ইউনুস এমএলএ, রাষ্ট্র ভাষা বাঙলার দাবীতে ভাঙ্গুড়া-চাটমোহর-ফরিদপুরের সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন তিনি; জনমত গড়ে তোলেন।
বাঙলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন আবু মুহাম্মদ ইউনুস আলী। ছাত্রজীবনের পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি, পূর্ব পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, এটাই প্রথম চাকুরি এবং শেষ চাকুরিও এটাই। কারণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে আর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের একজন প্রার্থী হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে থাকেন তিনি। তাঁর নির্বাচনী এলাকা পাবনা সদর উত্তর, ভাঙ্গুড়া-চাটমোহর-ফরিদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ছিলো পাবনা সদর উত্তর সংসদীয় আসন।
এই আসন থেকেই বিপুল ভোটে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাঁর ফলাফল তুলে দিলাম, তাঁর নির্বাচনী এলাকার নাম: পাবনা সদর উত্তর। মোট ভোটার: ৬৯,৫২৭। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী আবু মোহাম্মদ ইউনুস আলী ২২,৮৩৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগের আফজাল হোসেন পান মাত্র ২,৩৭৪ ভোট। দু’জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন এখানে। তাঁরা হলেন আমিন উদ্দীন আহমেদ ও আলী আসগর। তাঁদের প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ২৬৫ ও ১০৯।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তাঁর নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেন তিনি, নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষায়তন নামে একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আবু মুহাম্মদ ইউনুস আলী (ইউনুস এমএলএ), মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশী দোসর রাজাকার-আলবদরেরা তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রাখে; সেই ক্ষত আমৃত্যু তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন।
পাবনার ভাঙ্গুড়া-চাটমোহর-ফরিদপুর আসনে আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি, আবু মোহাম্মদ ইউনুস আলী; ইউনুস এমএলএ হিসেবে আমৃত্যু অত্র এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বার্ধক্যজনিত কারণে ভাঙ্গুড়ার নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: জান্নাতুন নাঈমা তূর্ণা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ভাষাসংগ্রামী ইউনুস এমএলএ-এর নাতনী।