মুক্তিযুদ্ধের কথ্য ইতিহাস তুলে আনতে চাই ব্লগে। সবাই লিখুন, আসুন ব্লগকে কাজে লাগাই ভিন্ন মাত্রায়
হালনাগাদ তথ্য যোগ করা হলো
১.
দিনাজপুরের প্রাণকৃঞ্চপুর গ্রামের অকুর বেওয়া লেখাপড়া জানে না। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যুদ্ধের কথা মনে আছে কিনা? ”হ, মনে আছে। তার আগে ভোট হইছিলো। তারপর গন্ডগোল লাগলো দেশত। মনে হয় চৈত্র মাসে খানরা আইসা গ্রামত আগুন দিলো। পরে খানরা আবার আইসে মানুষ মাইরে ফেলাইছিলো। খান সেনারা আইসে গ্রামের সব পুরুষ মাইনষেক মাইরে ফেলায় দিলো। মনে করেন, বাড়িত থাইক্যা ভোর হইছে সময় মাইনষেক ডাইকে নিয়া গেছে। নিয়া যায়ে তো সবাককে এক জাগায় জমা করিছে। হামার দেওর একজনা, ভাসুর একজনা, ভাতিজা একজনা, হামার স্বামী, হামার ব্যাটা, আমার জামাই, সব লুকায়ে ছিনু। সেই হান থেকি টানি বাইর কইরে নিয়া গেছে। নিয়া তো ওরা হামাক অত্যাচার করি আহত করছিলো।’ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ৯৬ সালে যখন এই কথ্য ইতিহাস তুলে আনে তখন অকুর বেওয়ার বয়স ছিল প্রায় ৬৬। এবার বলি বরিশালের রেবা রানী রায়ের কথা। তাঁর বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাবারই ছাত্ররা। ”বাবা বলছে যে, তোদের আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করছি; তোরা এখন আমাকে ধইরা নিবি! আমার কাছে টাকা আছে, স্বর্ণ অলংকার আছে, তোরা এইগুলি নিয়া নে। তখন তারা বলে যে, শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা যখন মানুষ করছো তখন করছো, এখন আর কি। তোর টাকা পয়সা আমরা চাই না। এই বইলা তারা আমার বাবাকে একটা গামছা দিয়া পিঠে হাত নিয়া বাইন্দা তাকে নিয়া চইলা গেলো। এদের মধ্যে ছিল রুহুল আমীন কইরা এক ছাত্র। অনেক দিন আগের কথা তো আমি অনেক নাম এখন ভুলে গেছি।”
কেই কি জানি এই রুহুল আমীন এখন কোথায়? আমি নিষ্চিত রেবা রানী অবশ্যই তা জানে। কিন্তু সবারই আসলে জানা দরকার এই রুহুল আমীনরা এখন কোথায়? কী করছে।
২.
যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৩ বছরের মতো। আমরা তখন ঝিগাতলায় থাকতাম। আমার কিছুই মনে নেই। অস্পষ্ট একটা ছবি আছে গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার। আমার বাবা চাকরি করতেন পিআইএ বা পাকিস্তান এয়ারলাইন্স-এ। সে সময় একদল পাকিস্তানের অধীনে চাকরি করবেন না বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবাও ছিলেন সেই দলে। আমার বাবা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি।
৩.
কিন্তু আমাদের চারপাশে এরকম অনেক আছেন যারা যুদ্ধ করেছেন। আবার এমমনও আছেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে দুঃসহ জীবন কাটিয়েছেন। আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা বলতে বললে কিছুই বলতো পারবো না। অথচ আমাদের বাবা-মা কিংবা অন্য আত্মীয় স্বজন কিংবা প্রতিবেশী সবারই কোনো না কোনো অভিজ্ঞতা আছে। সবাই লেখক না যে তারা সব কিছু লিখে রেখে যাবেন। আবার অনেকে আছেন তারা হয়তো লিখতেও পারেন না। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন প্রজন্মের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে কি আমরা এবং আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে?
৪.
আমার নানার বাড়ির পিছনে পাক সেনারা বাঙ্কার বানিয়ে ছিল যুদ্ধের পুরাটা সময়। আমার নানা বেঁচে নেই। আমি জানি না সে সময় তার দিনগুলি কেমন ছিল। আর আমার মামা দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়। আমার মামাও বেঁচে নেই। নাখাল পাড়ায় যখন থাকতাম পাশের বাড়ির বড় লোক প্রতিবেশীর শশুর আমার নানাবাড়ির লোক। কুখ্যাত এই লোকটিকে রাজাকারির বড় ধরনের অপরাধে যুদ্ধের পর গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার নানা বাড়ির গ্রামের প্রতিটা মানুষ জানে কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর কে রাজাকার। কার কি ভূমিকা-জিজ্ঞাস করুন, ঠিক ঠিক বলে দেবে। নাখালপাড়ায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার আদি মালিক ছিল মাহবুবুর রহমান গোরহা নামের এক লোক। একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় বইটা পড়ে আবিস্কার করলাম এই লোক একজন কুখ্যাত রাজাকার-আলবদর। আরও জানলাম এই বাড়িটা ছিল একটা টর্চার কেন্দ্র।
৫.
কিন্তু সব কথা কি আর বইতে লেখা থাকে? সবার কথা কি আমরা জানি? আমরা জানি গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদ-মীর কাশেম আলীর মতো কুখ্যাত কিছু মানুষের কথা। এর বাইরে মাঠে সক্রিয় ছিল আরও অনেকে। আমি এক বড় সাংবাদিকের কথা জানি, প্রেস কাবে চালু আছে যে ডা. আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দলে সেও ছিল। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলবদরের একজন প্রথম সারির সদস্য।
৬.
আসুন আমরা কথ্য ইতিহাস নামের একটা নতুন অধ্যায় যুক্ত করি এই ব্লগে। আমাদের চারপাশে যারা আছেন তাদের কাছ থেকে জানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। জেনে নেই আমাদের বীরত্বের কথা, আমাদের কারো কারো কাপুরুষতার তথা, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মানুষ না থেকে জানোয়ার হয়েছিল তাদের কথা। এই সব জানোয়ারদের অনেকেই মিশে আছে জনারণ্যে। বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত, বুক ফুলিয়ে আছেন। আসুন আশপাশের সবার সঙ্গে কথা বলে তুলে আনি সেই সময়ের ইতিহাস। এখানেই এমন অনেক গর্বিত ব্লগার আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। অনেকে বাবার সেই সব কাহিনী কিছু কিছু লিখেছেন। সবাইকে আহবান জানাই সেই সব ঘটনা নিয়ে আসুন ব্লগে।
৭.
আমরা ব্লগকে নতুন ভাবে কাজে লাগাতে চাই। নতুন কিছু যুক্ত হোক এখানে। দেশের জন্য বিশেষ কিছু করতে চাই আমরা ব্লগাররা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই আমরা সবাই। এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে আমরা সবাই এক হয়েছি। এর সঙ্গে যুক্ত হোক মৌলিক কিছু কাজ। কথ্য ইতিহাস ব্লগকে নিয়ে যাক অন্য এক মাত্রায়।
৮.
কর্তৃপরে কাছে আহবান জানাই আরও একবার এগিয়ে আসতে। ব্লগাররা কথ্য ইতিহাস তুলে আনলে সেগুলো একজায়গায় রাখতে চাই। এ জন্য আলাদা একটা জায়গা চাই আমরা। গ্রুপ ব্লগ বা এই জাতীয় কিছু চালু হলে একটা আর্কাইভের মতো হতে পারে সেটি। এখানে থাকবে এই সব কথ্য ইতিহাস। আসুন আমরা সবাই এগিয়ে আসি এই কাজটির জন্য।
আপডেট:
১। ভাল সংবাদ দিয়েই শুরু করি। সা.ইন কর্তৃপক্ষ সকালে জানিয়েছে যে তারা আর্কাইভ করার জন্য ব্লগে একটা জায়গা দেবে। সেটির লিঙ্ক থাকবে প্রথম পাতায়, যাতে সহজেই ব্লগার্কাইভে যাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ।
২. এর একটি নাম দিতে চাই। পেস্টের মন্তব্যে কৌশিক উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দিয়েছে। ব্লগারদের কাছ থেকে আরও শ্লোগান ও নাম চাই। সেখান থেকে বেছে নেবে একটা।
৩. সহব্লগার জ্বিনের বাদশা গত বছর প্রায় একই ধরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় বেশ কিছু ভাল লেখা পাওয়া গিয়েছিল। জ্বিনের বাদশা সেখান থেকে ২০টি লেখা বাছাই করে এখানে দিয়েছেন। অর্থাৎ শূন্য থেকে নয়, আমরা কাজ শুরু করলাম অনেক এগিয়ে থেকে।
১.
আমি জানোয়ার, ভাগীরথী মনে করিয়ে দেয়!: শুভ
২.
বীর আনোয়ারদের কথা : ধুসর গোধূলী
৩-১.
মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা – ০১ : ঝড়ো হাওয়া
৩-২.
মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা – ০২ : ঝড়ো হাওয়া
৩-৩.
মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা – ০৩ : ঝড়ো হাওয়া
৩-৪.
মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা – ০৪: ঝড়ো হাওয়া
৩-৫.
মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কথা – ০৫ : ঝড়ো হাওয়া
৪.
মেঝ খালার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা: অংকন
৫-১.
বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – ০১ : আবুল বাহার
৫-২.
বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – ০২ : আবুল বাহার
৬.
আমাদের পরিবারের অসাধারণ: সাজেদ
৭.
দুঃসাহসী দাস বাহিনীর কথা : হাসান মোরশেদ
১০.
‘৭১ এর বুড়ি:সাধারন কিছু মানুষের গল্প: ফারহান দাউদ
১১.
বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান: ফারহান দাউদ
১২.
আমার বাবা ও মুক্তিযু্দ্ধ: নাদান
১৩.
৭১ এর ঘটনা: এক ঝুড়ি কামরাঙা, আল্লাহর কাছে আমার যত কৃতজ্ঞতা : মেহরাব শাহরিয়ার
১৪.
জামায়াত, মুজাহিদ ,সাঙ্গপাঙ্গ আর নব্য জামাতীরা তো মানুষ নয়। এরা শকুনের দল!: তীরন্দাজ
১৫.
একটি নির্বিকার নৃশংসতার গল্প: রিয়াজ শাহেদ
১৬-১.
বেগমগঞ্জ কালো পুলের বধ্যভূমি: গোলাম আকবর (সৌজন্যে: মুকুল)
১৬-২.
গোপালপুরে গণহত্যা: গোলাম আকবর (সৌজন্যে: মুকুল)
১৭.
বাবার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধ: আহমেদ শরফুদ্দিন
১৮.
আমাদের টমি আর শের আলীর গল্প: এস্কিমো
১৯.
বিবিসি বাজার: মুক্তিযুদ্ধের অজানা কাহিনী: আমিনুল ইসলাম জুয়েল (সংগ্রহ: মো. তারিক মাহমুদ)
২০.
১৯৭১ এবং আমি: আরিফুল হোসেন তুহিন
৪। সহব্লগার নুরুজ্জামান মানিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে কথ্য ইতিহাস নামে একটি লেখা দিয়েছেন।