মুক্তিযুদ্ধের মৃত্যুঞ্জয়ী সংগঠক আবিদুর রেজা খান
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য ও সংসদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতিমান আইনজীবী, প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান, মাদারীপুর জেলার বাকশালের গভর্নর ও শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবিদুর রেজা খান সরল-সাধক মুখায়বের অধিকারী এই মানুষটি এখন লোকান্তরে। তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় এইতো সেদিনও ছিলো অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী গুণগ্রাহীদের পদচারণা। তাঁর মৃত্যুর মাত্র বারো বছরের মাঝেই অতীতের অতলগর্ভে বিলীন হয়েছে সবকিছু। কেবল শোকস্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত আবিদুর রেজা খানের স্মৃতি আজও ভাস্বর। তিনি আমাদের মাঝে তাঁর চারিত্রিক মহাত্ম ও অমায়িক গুণাবলীর দ্বারা এমন স্মৃতি রেখে গেছেন, যা ভুলে যাবার নয়। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সকলেই উপরোক্ত মন্তব্যের সাথে একমত হবেন। এজন্যই তাঁর মৃত্যুর বারো বছর অতিক্রান্ত হলেও মনে হয় তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। এমনই এক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো কিছু লিখতে গেলে মন হয়ে যায় আবেগপ্রবণ, ভাষা হারিয়ে ফেলি।
আমাদের সমাজে কারো মৃত্যু হলে তাঁর কথা স্মরণ করার প্রয়াস খুব লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে প্রয়াত আবিদুর রেজা খান সৌভাগ্যবান যে, তিনি এমন সকল গুণগ্রাহী রেখে গেছেন, যাঁরা তাঁর কর্মময় জীবন ও মৃত্যুঞ্জয়ী আদর্শকে স্মরণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রয়াত আবিদুর রেজা খান তাঁর সুদীর্ঘ ৮০ বছরের জীবনে তিনটি ক্ষেত্রে প্রধানত বিচরণ করেছেন, রাজনীতি আইন ব্যবসা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ। এই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। অমায়িক ব্যবহার, দেশপ্রেম ও কর্তব্য নিষ্ঠা পরিশ্রম আর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ছিলো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর এ কারণেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সকলের শ্রদ্ধা অর্জনে সামর্থ হয়েছিলেন।
আবিদুর রেজা খানের জন্ম ১৯২৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার দিগর মহিষখালী গ্রামে। ১৯৪৪ সালে ডামুড্যা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি আই.এ ও বি.এ. পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে রাজেন্দ্র কলেজে পড়ার সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে আসেন এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এল.এল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি আইন ব্যবসাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে ঢাকা বারে যোগদান করেন। জীবন সায়াহ্নে পর্যন্ত তিনি এই আইনের ভুবনে বিচরণ করেছেন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। ছাত্র অবস্হায় তিনি রাজনীতিতে যোগদান করে স্বীয় কর্মদক্ষতা, মেধা ও গণমুখী ভুমিকার কারণে তিনি একবার জাতীয় পরিষদ সদস্য ও দুইবার বাংলাদেশ সংসদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৬-৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দলনে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াইয়ে তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পরবর্তীতে গণ পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি নিজেকে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছেন। নীতি ও আদর্শের সাথে তিনি কখনোই আপোস করেননি। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করা, তাঁদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে তিনি স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন নির্লোভী, নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ, সৎ সাহসী চরিত্রের মানুষ। মন্ত্রী বা এম.পি. হওয়ার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। কোনো প্রকার লোভ-লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই।
একজন বিনয়ী ও অমায়িক ব্যবহার সম্পন্ন মানুষ হিসেবে মরহুম আবিদুর রেজা খান ছিলেন অতুলনীয়। দানশীলতা পরোপকার তাঁর চরিত্রকে করেছে মহীমান্বিত। তিনি আমৃত্যু শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষের সেবা ছিলো তাঁর জীবনের ব্রত। এলাকার অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা তাঁর দানে ধন্য হয়েছে। আর্তের সেবায় তিনি দান করেছেন অকৃপণ হস্তে। হাজী মুহাম্মদ শরীয়তুল্লাহ কলেজের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। শরীয়তপুরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন।
আবিদুর রেজা খান আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি রেখে গেছেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ, একজন খাঁটি দেশপ্রেমী, একজন শীর্ষস্থানীয় সমাজ সেবক, একজন নিষ্ঠাবান আইনজীবীর আদর্শ। তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী এই আদর্শের অনুশীলন ও মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন আগামীর প্রজন্মের কাছে। দেশের এই দুঃসময়ে আবিদুর রেজা খানের মতো ত্যাগী নিষ্ঠাবান আর সৎ নেতার বেশি প্রয়োজন। তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত নাগরিক শোকসভায় দেশের জাতীয় নেত্রীবৃন্দ, সাংবাদিক, আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যের মাঝেই প্রমাণ করেন তিনি কতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন। আমি এই মহান রাজনীতিবিদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: কাজী আব্দুস সবুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক কিংবদন্তির ছাত্রনেতা