মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
লেখক: আবুল কাশেম
তারিখ: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মরণপণ যুদ্ধ করে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ সৃষ্টি করে, বিশ্বসভায় অভ্যুদয় ঘটে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের। বিজাতীয় পাকিস্তানি শোষক এবং হানাদারদের বিতাড়িত করতে কোটি মানুষকে ঝরাতে হয়েছে স্বেদ, লাখো বাঙালিকে অকাতরে দান করতে হয়েছে জীবন, সহস্র মা-বোন দিয়েছেন সম্ভ্রম। বোধকরি, একমাত্র বাঙালি জাতিকেই জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য এত চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যেকটি পর্যায়ে আপামর জনসাধারণের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র ও শিক্ষাকর্মীদের গৌরবময় অংশগ্রহণ সংগ্রামকে অধিকতর শাণিত করেছে। আমাদের জাতীয় সত্ত্বা অর্জনের সর্বোচ্চ পর্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসেও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনার প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে জীবন বিসর্জন, অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে ঝাঁপিয়ে পড়া, মেধা ও মনন নিয়োগ করে বিভিন্ন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে অংশগ্রহণ করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাকর্মীবৃন্দ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক তথা এ দেশের সারস্বত সমাজের ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ছিলো অগ্রগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় পুরাতন। স্বাভাবিকভাবেই এই বিশ্ববিদ্যালয় মহান মুক্তিযুদ্ধে যথোচিত ভূমিকা পালন করে। প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভূমিকা উল্লেখ করা যেতে পারে। একাত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ভূগোল বিভাগের ড. সিরাজুল আরেফিন এবং ফলিত রসায়ন বিভাগের ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হন) ঐ সময় যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তরুণ অধ্যাপক জনাব সোহরাব আলী। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই ৩রা মার্চ ১৯৭১ শিক্ষক সমিতির সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নাজিম মাহমুদের স্মৃতিচারণে এ সংক্রান্ত তথ্যটুকু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
“রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ আসলেই তখন বেশ শাক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ। এই শিক্ষক সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন এ দেশের কজন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। অধ্যাপক হবিবর রহমান, প্রফেসর সালাউদ্দিন আহমদ, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম, প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী, প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন—এমন সব দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের সমাবেশ তখন সেখানে। তাঁদের উদ্যোগে এবং উৎসাহে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই আহূত হলো শিক্ষক সমিতির সভা। ড: সিরাজুল আরেফিন সভাপতি এবং প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক। শিক্ষক সমিতির সভায় সাধারণত কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত হবার কথা নয়। আমিও সেখানে যাইনি। তবে দেশের চলতি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমাজের অনুসৃতব্য বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি যেহেতু এই সভায় বির্ধারিত হবে, সে কারণে কতকটা আবেগতাড়িত হয়ে উত্তেজনাবশত জুবেরী ভবনের বারান্দায় আমি অস্তিরভাবে পায়চারী করতে লাগলাম। পূর্ব লাউঞ্জে শিক্ষক সমিতির সভা চলছে। মাঝে মাঝে গরম গরম কথাও কানে আসছে। শিক্ষকেরা দারুণ বিক্ষুব্ধ। উঁচু পর্দায় তাঁদের কণ্ঠস্বর। হঠাৎ তখনই পূর্ব লাউঞ্জের জানালা দিয়ে দ্রুত লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন বেশ কজন শিক্ষক। বারান্দায় বেরিয়ে তারা এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রায় দৌড়ে সোজা তাঁদের বাড়ীর পথ ধরলেন। তক্ষুণি কিছুই আমি বুঝতে পারিনি। কি ব্যাপার। কি হলো। কজন শিক্ষক অমন ভয়ে ভয়ে সভা ত্যাগ করে পালালেন কেন! সভা শেষ হতেই সব শোনা গেল। তরুণ তেজী শিক্ষকদের কেউ কেউ ওই সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জোর দাবী তোলেন এবং এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সভায় উপস্থিত সদস্যদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। দেশদ্রোহিতার ভয়েই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, কজন শিক্ষক তখন জানাল দিয়ে বেরিয়ে সভা থেকে কেটে পড়েন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি ওই সভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরের উপর অর্পণ করেন। যথাসময়ে বন্ধবন্ধু সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সভায় এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়।”
তবে মার্চ মাসের শেষের দিকে একদিন তিন জন শিক্ষক রাজশাহী বেতার ভবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে যান। তাঁরা হলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের খালিদ হোসনে, ফলিত রসায়ন বিভাগের শহিদুল ইসলাম এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুর রাজ্জাক। শহীদুল ইসলামের ভাষ্য মতে অনুষ্ঠান ঘোষণা কক্ষে তাঁরা প্রবেশও করেছিলেন। কিন্তু মাইক্রোফোনের সুক্ষ্ম টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাবে তাঁদেরকে ফিরে আসতে হয়।
রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের তিনজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁরা হলেন হবিবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আব্দুল কাইউম। গণিত বিভাগের সভাপতি ছিলেন শহীদ হবিবুর রহমান। শিক্ষা জীবনের প্রায় সকল পরীক্ষায় স্বর্ণদকসহ উত্তীর্ণ হন। আলীগড় ও কেম্ব্রিজ থেকে ডিগ্রী নেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শন রেডিক্যাল হিউম্যানিজমে বিশ্বাস করতেন তিনি। একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক রাজশাহী দখলের প্রাকমুহূর্তে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে ক্যাস্পাস পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিলে তিনি বীরোচিত জবাব দেন ‘ক্যাপ্টেন কখনও যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে না’। ১৫ই এপ্রিল ক্যাম্পাসের ১৫/বি নম্বর বাসা থেকে পাকিস্তানি অনুচরদের সহায়তায় ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্ণেল তাজ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর আর অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ভাষা বিভাগের অধীনে সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার। নাজিম মাহমুদের জবানীতে তাঁর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শোনা যাক:
“একাত্তর চৌদ্দই এপ্রিল সকাল। হিন্দুর রক্তপানের প্রবল তৃষ্ণায় জীপভর্তি পাকসেনারা এলো ৭১ নম্বর দালানোর সামনে। ওই দালানোর নিচের তলায় একটি ফ্লাটে বাস করতেন ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই দেশ ত্যাগ করলেও অধ্যাপক সমাদ্দার মাটি কামড়ে ছিলেন। কোথাও যাননি। কেন যাবেন। তিনি হয়ত জানতেন, তিনি নিরীহ নিরপরাধ, সাতে পাঁচে নেই নির্লিপ্ত সৎ নাগরিক। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়াই যে পাকসেনাদের কাছে বড় অপরাধ এই সহজ কথাটি কি অধ্যাপক সমাদ্দার একেবারেই বোঝেন নি? না, তা নয়।
‘মরতে হয় দেশের মাটিতে মরবো। আমরা হয়ত বাঁচবো না। তবে এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই’। মৃত্যুর কদিন আগে এমন উচ্চারণ করেছিলেন অধ্যাপক সমাদ্দার। শুধু তাই নয়। গান পাগল এই মানুষটি জীবনের শেষ কদিন কান্না জড়ানো গলায় কেবলই গাইতেন-‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
‘ইধার কোঈ হিন্দু আদমি হ্যায়? ফেরীঅলার মতো হাঁকাহাঁকি করলো সেই পাকসেনার দল।
‘হিন্দু ইধার নেহি হ্যায়’-এই মিথ্যা উচ্চারণ করে সেদিন তাদের ফেরাতে চেষ্টা করলেন অধ্যাপক সমাদ্দারের অবাঙালি প্রতিবেশী, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মহৎপ্রাণ অধ্যাপক মুহম্মদ জুনায়েদ।
কিন্তু রক্তপায়ী মানুষ কি আর সহজে শান্ত হয়, তাদের ঠেকানো যায়? শেষ রক্ষা তাই হয়নি। ‘সমাদ্দার নাম শুনে পাকসেনারা কিছু বুঝতে না পারলেও সবকিছু তাদের বাত্লে দেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ড. মতিউর রহমান ও ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক প্যাটেল। এই দুই অবাঙালী শিক্ষক তখন মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি। অধ্যাপক সমাদ্দারকে তাঁরাই শনাক্ত করলো-এই তোমাদের হিন্দু শিকার। তারপর কতজনের কাছে ছুটে গেলেন শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার। তাঁর স্বামী কোথায়, কেউ বলেন না। এমন কি দুজন শনাক্তকারীও চুপ। ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন তাঁকে সান্তনা দেন-ঢাকায় আছেন তাঁর স্বামী। একাত্তরের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসবাদী জনৈক দালাল শহীদ-পত্নীর হাতে ফেরত দিলেন তাঁর স্বামীর চশমা ও স্যান্ডেল। বাহাত্তর সালের মার্চে ‘পূর্বদেশে’ সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার উল্লেখ করলেন শহীদ পত্নী শ্রীমতী সমাদ্দার, কিন্তু কে সেই দালাল তার মুখোশ আর উন্মোচন করলেন না। কেন। ‘বীরের এ রক্তস্রোতের মাতার এ অশ্রু ধারায়’ অবশ্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নাম প্রকাশ করলেন: আইনজীবী শরিফ আহমদ (পূর্বদেশ: ২৫ নভেম্বর ৭২)।”
কাজলার পুকুর পাড়ে অধ্যাপক সমাদ্দারকে হত্যা করা হয়। গ্রামবাসীরা সেখানেই তাঁর লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গ্রামবাসী ও পরিবার পরিজনদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁর দেহাবশেষ তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রবেশ পথের বামপাশে সমাধিস্থ করা হয়।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইউম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র অল্প কয়েকদিন আগে শহীদ হন। মীর আব্দুল কাইউম যখন স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের দিন গুণেছিলেন তখনই ২৫শে নভেম্বর রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারাস্থ শ্বশুরালয় থেকে ঘাতক বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী রাত্রিবেলা এসে একজন আর্মি আফিসার কথা বলতে চান বলে অধ্যাপক কাইউমকে জানায়। তিনি আর্মি অফিসারকে বাসায় আনতে বললে ঘাতকের সহযোগী তৈয়ব অফিসারের বাসায় আসার অপরাগতা জানায়। অধ্যাপক কাইউম পরিচয়পত্রসহ রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তাঁকে মিলিটারির গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। শহরের বোয়ালিয়া ক্লাবের পাশে বাবলা বনের বধ্যভূমিতে তাঁকে’সহ ১৪ জনকে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
তিনজন শিক্ষক ছাড়াও বেশ কয়েকজন কর্মচারীও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। পদবী ও শহীদ হওয়ার তারিখসহ তাঁদের নাম নিম্নরূপ:
আব্দুর রাজ্জাক, নৈশ প্রহরী, ২৫ শে মার্চ; শেখ এমাজউদ্দিন, স্টেনো টাইপিষ্ট, ৬ই নভেম্বর; এস.এম. সাইফুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী, ১৩ই নভেম্বর; মো. কলিম উদ্দিন, প্রকৌশল কর্মসহযোগী, ১৩ই এপ্রিল; মোহন লাল, সুইপার, ১২ই এপ্রিল; আবুল আলি, ড্রাইভার, ৬ই নভেম্বর; শফিকুর রহমান, কার্পেন্টার, ৭ই নভেম্বর; নূরু মিয়া, প্রহরী; মোহাম্মদ ইউসুফ, জরুরী পিয়ন, ১৪ই এপ্রিল; মো. ওয়াজেদ আলী, পিয়ন, ১৩ই নভেম্বর; মো. আফজাল মৃধা, প্রহরী, ২৫ শে মার্চ; ওয়াহাব আলী, ওর্ডারলি পিয়ন, ২৪ শে এপ্রিল, আব্দুল মালেক, বেয়ারার, জুন মাসে নিহত; কোরবান আলী, প্রহরী, ২৪ শে এপ্রিল; ইদ্রিস আলী, পানি বাহক, অক্টোবর মাসে নিহত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাঁরা হলেন—আব্দুল মান্নান আখন্দ, (বাণিজ্য বিভাগ), আমীরুল হুদা জিন্নাহ, (বাংলা বিভাগ), গোলাম সওয়ার খান সাধন, এম.এস-সি (পূর্বভাগ), প্রদীপ কুমার রাহা, (রাসায়ন বিভাগ), মোহাম্মদ আলী খান, (অর্থনীতি), শাহজাহান আলী, (বাণিজ্য বিভাগ), মিজানুল হক এম.এস-সি (পূর্বভাগ), আলমগীর হোসেন (সমাজকর্ম), মোশারফ হোসেন রঞ্জু (অর্থনীতি)। শাহাদাত বরণকারী এই ছাত্রদের প্রায় সবাই অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে গিয়ে অকাতরে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাঁরা।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উপর একটি জরিপ চালানো হয়। ৯০৯ জন ছাত্রের উপর জরিপ চালিয়ে ১০১ জনের (১১%) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়। এই ১০১ জন ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধার ৮৫ জনই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফ্রন্টে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করেছেন, ৫ জন ছিলেন সংবাদবাহক এবং একজন গোয়েন্দা। ৯৩ জনই ভারতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন, অবশিষ্ট ৮ জন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাদের ৮৯%-এর বয়স ছিল ১৯ থেকে ২৫ বংসরের মধ্যে। প্রায় ৯০% ই ছিলেন গ্রামীণ পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই ১০১ জন ছাত্রের ৯%-এর পরিবারে অন্তত একজন করে শহীদ হয়েছেন।
বেশ কয়েকজন শিক্ষক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক অমানসিক অত্যাচারের শিকার হন। এদের মধ্যে গণিত বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে মে মাসে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেনাছাউনিতে রূপান্তিত করার বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ করেন এবং নিজ নাম বদলিয়ে ‘দেবদাস’ রাখেন। নাটোরে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাঁকে চার মাসব্যাপী যে অমানবিক অত্যাচার করা হয়, তাতে তিনি স্থায়ীভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ‘জীবন্ত শহীদ’ হিসেবে অধ্যাপক মজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস এখনও জীবিত আছেন। মুক্তিযুদ্ধে এই অভূতপূর্ব ত্যাগের জন্য ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমদ (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং নাটোরের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাঁর উপর চারমাসে ধরে পাকিস্তানি বাহিনী নির্যাতন চালায়। ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের ড. এম.এ রকিবকে (পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) একটি নির্যাতন শিবিরে নয় দিন বন্দী করে রাখা হয়। বাংলা বিভাগের ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ১লা মে বন্দী করা হয়। তাঁকে ২৪ ঘন্টা পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
একাত্তেরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ৩০ শে জুনের মধ্যে সকল শিক্ষক কর্মচারীকে চাকুরিতে যোগদান করতে আদেশ দিলেও বেশ কয়েকজন শিক্ষক দেশের অভ্যন্তরে থেকেও মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। এরা হলেন ড. আব্দুল হক (আইন) মনিরুজ্জামান (ভূগোল), আব্দুল হালিম (সমাজকর্ম), আব্দুর রহিম (গণিত) ও জুলফিকার মতিন (বাংলা)। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জুলফিকার মতিন ছিলেন সবচেয়ে বেশি রাজনীতিকৃত শিক্ষকদের একজন। ১৯৬৭ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। পরপর দুইবার তিনি রাকসুর সর্বোচ্চ পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি নিজ এলাকা উল্লাপাড়ায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা লতিফ মির্জার সাথে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, বেলকুচি প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই সময় বেলকুচি থানা সদর থেকে ‘বাংলার মুখ’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশেও ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁর মৃত্যুদণ্ড ষোষণা করে।
বহু সংখ্যক শিক্ষক সীমন্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় করেন। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শিক্ষকরা হলেন: প্রফেসর মযহারুল ইসলাম (বাংলা), প্রফেসর কাজী আব্দুল মান্নান (বাংলা), সুনীল মুখোপাধ্যায় (বাংলা), গোলাম মুরশিদ (বাংলা), আসাদুজ্জামান (বাংলা), আব্দুল হাফিজ (বাংলা), আলী আনোয়ার (ইংরেজি), অসিত রায় চৌধুরী (ইংরেজি), ইনারী হোসেন (ইংরেজি), ড. সফর আলী আকন্দ (ইতিহাস), আব্দুল গনি (ইতিহাস), প্রফেসর মুশাররক হোসেন (অর্থনীতি), সনৎকুমার সাহা (অর্থনীতি), মোহাম্মদ ইউনুস (অর্থনীতি), অজিত ঘোষ (অর্থনীতি), মোশাররফ হোসেন (অর্থনীতি), দীলিপকুমার নাথ (তখন তিনি বি.এম. কলেজের প্রভাষক ছিলেন) (অর্থনীতি), ড. মফিজউদিদ্দন আহমদে (দর্শন), খানম মমতাজ আহমেদ (দর্শন), রমেন্দ্রনাথ ঘোষ (দর্শন), আহাদ আলী মন্ডল (দর্শন) (দর্শন), মিসেস হোসনে আরা (সমাজকর্ম), আব্দুর রাজ্জাক, (মনোবিজ্ঞান), হাবিবুর রহমান (আইন), ড. ফারুক খলিল (গণিত), ড. সুব্রত মজুমদার (গণিত), শিশির কুমার ভট্টাচার্য (গণিত), আফতাবুর রহিম (গণিত), মীর ওয়াহেদুল ইসলাম (গণিত), আব্দুস সাত্তার (পরিসংখ্যান), জিল্লুর রহিম (রসায়ন), সায়েন উদ্দিন আহমদ (রসায়ন), দাস বাসুদেব (রসায়ন), সুভাষ চন্দ্র পাল (রসায়ন), পরিতোষ চক্রবর্তী (রসায়ন), ড. আনিসুর রহমান (ফলিত রসায়ন), ননী ভূষণ ফৌজদার (ফলিত রসায়ন), শহীদুল ইসলাম (ফলিত রসায়ন), ড. এবনে গোলাম সামাদ (উদ্ভিদ বিদ্যা) প্রমুখ। এই সকল শিক্ষকের অধিকাংশই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অধীনে কোন না কোন কাজে নিয়োজিত থেকে মুজিবনগর সরকারকে প্রশাসন পরিচালনা ও মুক্তিযুদ্ধকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেন। অর্থনীতি বিভাগের ড. মুশারফ হোসেন মুজিবনগর সরকারের ও পরিকল্পনা সেল-এর (তখন পুর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়নি) সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ’পরিকল্পনা সেল’ গঠিত হয়। অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. খান সারওয়ার মুরশিদ এবং ড. আনিসুজ্জামান।
প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ভারতে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অর্থনীতি বিভাগের সনৎকুমার সাহা পরিকল্পনা সেলে রিসার্চ অফিসার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ড. এবনে গোলাম সামাদ ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ করতেন। গণিত বিভাগের শিশির কুমার ভট্টাচার্য পরিকল্পনা সেলের অধীনে বিজ্ঞান শিক্ষা সংক্রান্ত প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। এই প্রকল্পের কাজ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করা। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শিক্ষকদের প্রায় সবাই শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে কাজ করেন। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি বাঙালির অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। জন্মভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া এই সকল নিঃস্ব মানুষ মানসিকভাবেও ছিলেন অত্যন্ত বিপর্যস্ত। শিক্ষকরা এই শরণার্থী ক্যাম্পসমূহে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতেন যার ভিত্তিতে মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজতর হত। তাছাড়া অসহায়, বিপর্যস্ত ও নিঃস্ব মানুষকে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জনের এই কঠোর সংগ্রামে ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করতেন। ইতিহাসের আব্দুল গনি, গনিতের মীর ওয়াহেদুল ইসলাম মালদা এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করেন। দর্শনের রমেন্দ্রনাথ ঘোষ বনগাঁ সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে উপাত্ত সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রচেষ্টায় বরদা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভিজিটিং ফেলোশিপ পান। বরদায় স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের বাইরেও বহু সেমিনার, আলোচনা সভা ও মিটিংয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট এবং পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও অত্যাচারের কাহিনী স্থানীয় জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করে জনমত সংগঠিত করেন। ইতিহাসের সফর আলী আকন্দ প্রথমে মুজিবনগর সরকারের হেড কোয়ার্টারের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। পরে তিনি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী নিয়ে যান এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে স্থানীয় জনগণের ধারণাকে স্বচ্ছ করতে সহায়তা করেন। ইংরেজির আলী আনোয়ার শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পে কাজ করার পরও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, শিল্পী সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করতেন। অর্থনীতির মোহাম্মদ ইউনুস শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ট্রানজিট ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাথে সকল শিক্ষকের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও পরবর্তীকালে এই শ্বিবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এমন তিনজন মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজ করেন। তাঁরা হলেন ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, প্রীতিকুমার মিত্র ও দীলিপকুমার নাথ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। সকলের একটিই আকাঙ্ক্ষা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ও বাংলাদেশে অবস্থানরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুযোগ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। এটা পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় বেশ কতক প্রগতিশীল শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। চরি ধরনের শাস্তির কথা এখান থেকে জানা যায় যথা মৃত্যুদণ্ড, চাকুরিচ্যুতি, গ্রেফতার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন প্রফেসর মযহারুল ইসলাম, গোলাম মুরশিদ, জুলফিকার মতিন, ড. মফিজ উদ্দীন আহমেদ, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, সনৎ কুমার সাহা, খালিদ হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, ড. এবনে গোলাম সামাদ ও কাজী সালেহ আহমেদ। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে যে সকল শিক্ষক ও কর্মকর্তার কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয় তারা হলেন আব্দুল খালেক, ড. আব্দুল হক, আব্দুল হাফিজ, অসিত রায়চৌধুরী, প্রফেসর কাজী আব্দুল মান্নান, সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. ফারুক খলিল, ড. সুব্রত মজুমদার, শিশির কুমার ভট্টাচার্য, মনিরুজ্জামান, অজিত কুমার ঘোষ, ড. এম. এ. রকিব, নাজিম মাহমূদ (ডেপুটি রেজিষ্ট্রার হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) ও প্রকৌশলী মোজাহার হোসেন। তৃতীয় ক্যাটেগরিতে শাস্তি ছিল চাকুরি থেকে বরখাস্তকরণ। যে সকল শিক্ষককে এই ক্যাটাগরিতে চাকুরিচ্যুত করা হয় তারা হলেন আলী আনোয়ার, আতাউর রহমান, সফর আলী আকন্দ, আব্দুল গনি, আমিরুজ্জামান ও মোশাররফ হোসেন। চতুর্থ ক্যাটাগরিতে শাস্তি হিসেবে বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলীর আদেশ দেওয়া হয়। বদলীর আদেশপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন প্রফেসর সালাউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), প্রফেসর খন্দকার মনোয়ার হোসেন (পরিসংখ্যান), প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী, প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (ইংরেজি), প্রফেসর আলী মোহাম্মদ ইউনুস (উদ্ভিদ বিদ্যা), ড. কায়েস উদ্দিন (প্রান রসায়ন), ড. শামসুল হক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) ও কাজী হাসিবুল হোসেন (সমাজ বিজ্ঞান)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের ফ্রন্টে শত্রুর মোকাবেলা করেন। একটি কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার যে, বয়সে তরুণ এই সকল শিক্ষক-মুক্তিযোদ্ধাগণ একাত্তর সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক ছিলেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ হলেন শামসুল আলম বীর প্রতীক (বর্তমানে ভূগোল বিভাগের প্রফেসর), ইতিহাস বিভাগের মনজুর মুরশেদ, দর্শনের আব্বাস আলী, ফলিত রসায়নের আবুল হোসেন মোল্লা এবং বাবস্থাপনার মলয় ভৌমিক (তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন)। শামসুল আলম বীর প্রতীক একাত্তর সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশন পান এবং লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। প্রথমে তিনি ৭ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে তাঁকে ১১ নং সেক্টরে বদলী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যের জন্য গর্বিত।
লেখক: আবুল কাশেম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান; ইতিহাস বিষয়ক গবেষক ও লেখক।