মুজিবনগর সরকার : সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীন জুটির শক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা
১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি প্রাশাসনিক স্মরণীয় দিন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ২২ দিন পর ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রবাসী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। ওই সরকারের নেতৃত্বেই প্রায় ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’।
যে জাতি তার মহান সন্তানদের ভুলে যায়, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো স্বাধীন ভূখণ্ড ছিলো না। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে। এ সময় বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির সুখ্যাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতাকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মন্ত্রিসভার সদস্য এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক চক্র নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। গ্রেফতার হওয়ার আগে সুপরিকল্পিতভাবেই বাঙালি জাতির নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা রাতারাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার বরণের পর তাজউদ্দীন আহমদ’সহ অন্য তিন নেতা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ২৫ মার্চ রাতে অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি অন্য সবাইকে নিরাপদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং ঘাড়ে একটি রাইফেল নিয়ে তাঁর বাসা থেকে বের হন। আরহাম সিদ্দিকীর মাধ্যমে তিনি এই রাইফেল আগেই সংগ্রহ করেন। এরই মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ রাইফেল প্রশিক্ষণও গ্রহণ করে ফেলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমীর-উল-ইসলামের ২৫ মার্চ রাতে এক বাড়িতে একত্র হওয়ার কথা ছিলো। এই তিনজন ‘৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সব কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন। ড. কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত ওই রাতে অজানা কারণবশত নির্ধারিত বাড়িতে একত্রিত হননি। পরে তিনি গ্রেফতার(!) হয়ে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থাকেন। ‘৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি একই বিমানে স্বদেশে ফিরে। ২৫ মার্চ রাতে ড. কামাল হোসেন কি কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে একত্রিত হননি-এই বিষয়টি আজও পরিষ্কার হয়নি। ড. কামাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে স্বেচ্ছায় কারাবন্দিত্ব গ্রহণ করেছিলেন কিনা, গত ৪২ বছরে একবারও তিনি এই বিষয়ে মুখ খোলেননি। দু’রাত একদিন গোলাগুলির মধ্যে আটক থেকে ২৭ মার্চ তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলাম ঢাকা ছাড়েন। এই দু’জন নানা জনপদ ঘুরে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। ৩০ মার্চ বিকেলে তাঁরা মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিনকে নিয়ে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন।
ভারতীয় বিএসএফের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর সীমান্ত অতিক্রম করে ওই রাতে কলকাতা পৌঁছেন। রাতেই একটি সামরিক বিমানে তাঁরা দিল্লি চলে যান। প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের এটাই ছিলো প্রথম যোগাযোগ। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কারণে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের একটা পূর্ব যোগাযোগ ছিলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘৭১-এর ৬ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকাস্থ তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কেসি সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্যোগে পড়লে ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে কতটুকু সাহায্য-সহায়তা করবে, ওই বৈঠকে তাই নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের পর কেসি সেনগুপ্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য দিল্লি যান। ঢাকা ফিরে কেসি সেনগুপ্ত ১৭ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তান সামরিক আঘাত হানলে ভারত যথাসম্ভব সাহায্য-সহায়তা করবে। ভারতীয় সাহায্যের রূপরেখা কি হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ২৪ মার্চ আরেকবার মিলিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই বৈঠকটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এই অসমাপ্ত সংলাপের কারণে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ ও ভারতের মাটিতে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ বেস গঠনের বিষয়টি আর স্থির হতে পারেনি।
৩০ মার্চ রাতে দিল্লি পৌঁছার পর তাজউদ্দীন আহমদ ৪ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে কোনো সহযোগী ছিলো না। সাক্ষাৎ শেষে সহকর্মী আমীর-উল-ইসলামকে তাজউদ্দীন জানান, মিসেস গান্ধী বারান্দায় পাঁয়চারী করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে বহনকারী গাড়ি পৌঁছার পর তাঁকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্ট্যাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস গান্ধী প্রশ্ন করেন, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অলরাইট?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ২৫ মার্চের পরে তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়নি।’ তাজউদ্দীন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আগত শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার আমাদের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা কোনভাবেই সফল হতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি জানান, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি শত্রুতা নয়। বাঙলার মানুষের সংগ্রাম, মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। সব গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহযোগিতা আমরা চাই।’ এভাবেই ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
২৫ মার্চে পাকিস্তানি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি আঘাতের পর আওয়ামী লীগের নেতারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কে জীবিত আছেন, কে নেই, তাও তারা জানেন না। বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি অবস্থায় রয়েছেন? তাও কারও জানা ছিলো না। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন নাকি পাকিস্তানি দস্যুরা তাঁকে হত্যা করেছে, এই কথাও কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হলো, মুক্তি সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন শত্রুর কারাগারে বন্দী। তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জরুরিভাবে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি বেতার স্টেশনের।’ কিন্তু পঁচিশে মার্চের আঘাতের ১১/১২ দিন পরও অন্য কোনো নেতার হদিস মিলছে না। একমাত্র লোক আমীর-উল-ইসলাম, যার সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে পারেন।
অন্য সব প্রধান নেতার অনুপস্থিতিতে কে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, উপরের সারির নেতারা কে কোথায় রয়েছেন, কেউ গ্রেফতার বা নিহত হয়েছেন কিনা, এসব কোনো কিছুই তাজউদ্দীন আহমদের তখনো জানা ছিলো না। প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। ওই সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করাটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিলো না। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১০ এপ্রিল প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণও রেকর্ড করা হয়। ইতিমধ্যে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুব ও ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতা পৌঁছে যান। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবেই বিবেচিত হয়। ১০ এপ্রিলের পর প্রথমে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান, তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এবং আরও পরে খন্দকার মোশতাকসহ অন্য নেতারা কলকাতা পৌঁছেন। খন্দকার মোশতাকের বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ আরো অনেকের সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত সরকার বহাল থেকে যায়।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের অসহযোগিতা এবং বিরোধিতার মুখেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মোশতাক গং আমেরিকার চক্রান্তে একবার ধোয়া তোলেন, ‘স্বাধীনতা পেলে শেখ মুজিবকে জীবিত পাওয়া যাবে না, আর শেখ মুজিবকে পেলে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না।’ ওই কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএদের এক যৌথসভায় তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই চাই। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে চাই না।’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এতটাই প্রাণস্পর্শী ও যুক্তিযুক্ত ছিলো যে, কয়েকজন মোশতাকপন্থী চক্রান্তকারী ছাড়া সভায় উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে তাজউদ্দীনের সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকেন।
ভারতে তাজউদ্দীন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোরালো হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে এমপিএ ও এমএনদের আস্থা নিতে বলেন মিসেস গান্ধী। ’৭১-এর ৫ জুলাই জলপাইগুড়িতে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের ওই সভা হয়। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির (সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক নন) ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার’ গ্রন্থে ওই সভার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। ওই সভায় আবদুল আজিজ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার পক্ষে জোরালো বক্তব্য শুরু করলে মোশতাকপন্থী চক্রান্তকারীরা উল্লাসমুখর হয়ে ওঠে। ওই পরিস্থিতিতে ময়েজউদ্দিন আহমদ নাটকীয়ভাবে মঞ্চে উঠে আবদুল আজিজকে শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে মঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে এক আবেগময়ী জোরালো ভাষণ দেন। ২৩৯ জন এমপিএ ও ১৩৫ জন এমএনএ উপস্থিত থাকা ওই সভায় তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ময়েজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাক আহূত এমপিদের সভায়ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। চক্রান্তকারী মোশতাক গংয়ের উদ্দেশ্য ছিলো তাজউদ্দীনকে সরিয়ে মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী করা। আর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানের বাদশা রেজা শাহের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করা।
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ওই গ্রন্থে আরও লিখেছেন, ‘৭১-এর ১১ জুলাই কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক সভার কথা। এতে বলা হয়, মেজর জিয়াউর রহমান এক পর্যায়ে ওই সভায় অবিলম্বে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার কথা বলা হয়। ওই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিলো দুটি। ওই প্রস্তাব গৃহীত হলে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে একদিকে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যদিকে ওসমানী অপসারিত হলে জৈষ্ঠ্য সামরিক অফিসার মেজর জিয়া প্রধান সেনাপতি হবেন। মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদের বিরোধিতার কারণে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনে মেজর জিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। ওই প্রস্তাবের পর কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অনেক বুঝিয়ে ওসমানীকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে রাজি করান। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর জিয়ার সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মেজর জিয়াকে তিনবার গ্রেফতার করতে প্রধান সেনাপতি ওসমানী নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ (জাতীয় সংসদে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ এই তথ্য দেন। মেজর রফিকের লেখা নিবন্ধ। মাহবুব করিম সম্পাদিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ-নেতা ও মানুষ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-৮৯)।
তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সফল নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২ বছর ১০ মাস পর মোশতাক ও উচ্চাভিলাষী চক্রান্তকারীরা অবশেষে সফল হলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪-এর ২৬ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা নিশ্চয়ই একদিন একমত হবেন, ভারতের গান্ধী-নেহরু, চীনের মাও-চৌএনলাইয়ের মতো আরেক সফল জুটি ছিলেন বাংলাদেশের মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি।