সাক্ষাৎকার

মেয়েদের শিক্ষা ও কাজ দিলে বাল্যবিবাহ কমবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মেয়েদের যদি শিক্ষা ও কাজের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে অভিভাবকরা মনে করেন, বিয়ে একটি মেয়ের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। গত ১ জুলাই রাতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ টেলিভিশনে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন শেখ হাসিনা।
জাতিসংঘ ঘোষিত সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বিষয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে সরাসরি প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ প্রচার করা হয়। বিবিসির অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন মিশাল হুসেন। এতে বলা হয়, মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুর হার কমানো, শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার বাড়ানোসহ কয়েকটি এমডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ সফলতা দেখিয়েছে।
ওই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ দমন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনায় তার সরকার সফল হয়েছে। বিবিসি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া পুরো সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিচে তুলে ধরা হলোÑ
এমডিজি অর্জন : বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এতে বলা হয়, এ সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে বলেন, তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইন করেই শুধু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। মেয়েদের সক্ষম করে তুললেই এই প্রবণতা কমবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্কুলে বিনামূল্যে বই সরবরাহের ব্যবস্থা করেছি। এখন কোনো বাবা-মাকে সন্তানের বই কেনার বিষয়ে ভাবতে হয় না।
নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে কিছু ঝরে পড়া রয়েছে। কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য।
এমডিজি বাংলাদেশ কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেÑ এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বিবিসিকে বলেন, এখন আমি বলতে পারি, আমরা ১ থেকে ৬টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছি। আমরা অনেক কিছু করেছি।
দুর্নীতি কমাতে পদক্ষেপ : টিআইয়ের দুর্নীতির সূচকে ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫তমÑ এ কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়, যুক্তরাজ্যের করদাতারা কেন বাংলাদেশকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক শাসকরা বারবার এদেশ শাসন করেছে। এতে গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চা হলে এবং দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতি কমে। আমরা দুর্নীতি কমাতে পারতাম। কিন্তু দুর্নীতি এখন সর্বব্যাপী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের গণতন্ত্র কেবল বিকশিত হচ্ছে। ব্রিটেনে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে ২০০-৩০০ বছর ধরে থেকে। বিবিসির সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন, আপনাদের দেশে দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে?
বাংলাদেশ এখনও ধর্মনিরপেক্ষ : প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ এখনও ধর্মনিরপেক্ষ আছে বলে তিনি মনে করেন কি-না। শেখ হাসিনা বলেন, অবশ্যই আছে। ১৯৭৫ সালে আমার বাবাকে হত্যার পর সামরিক শাসক দেশের ক্ষমতা নেয়। তারা সংবিধান সংশোধন করে এবং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি বাদ দেয়। আমার দ্বিতীয় দফা শাসনামলে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করি।
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে : তিন ব্লগারের ভয়াবহ হত্যাকা-ের প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করা হয়, সরকারের সঙ্গে জঙ্গি ইসলামপন্থিদের কোনো সমস্যা আছে কি-না। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি জঙ্গিদের উৎসাহিত করেছে। আমাদের দুজন সাংসদকে হত্যা করা হয়েছে। আমিও আক্রান্ত হয়েছি। আমি সরকার গঠন করার পর থেকে সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থিদের ছাড় না দেওয়ার কথা ঘোষণা করি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদ দমনের বিষয়টি অনেক কঠিন হলেও এখন তা নিয়ন্ত্রণে আছে।
এখন কী হচ্ছেÑ এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, একটি বা দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে কী হয়েছে? তা হলে আমরা কি ওই দেশটিকে কেবল সন্ত্রাসীদের দেশ বলব? মোটেও তা নয়।
জঙ্গিদের হত্যাকা-ের তালিকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তালিকার ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় সব ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া, ওই তালিকা যারা বানিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। … সমালোচনাকারীরা যে কোনো কিছু বলতে পারে। তারা ভালো কিছু দেখে না। আমি আমার কাজ করছি। আমরা অবশ্যই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি।
মোদির মন্তব্য নিয়ে : বিবিসির প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বললেন, আপনি একজন নারী হয়েও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। তার ওই বক্তব্যে আপনার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আপনি জানেন, এই সমাজ পুরুষশাসিত। পুরুষরা সব সময়ই ভাবে, তারাই ভালো কাজ করতে পারে। কিন্তু এই উপমহাদেশেরই অনেক দেশ শাসন করছে নারীরা। আমাদের দেশে আমার সরকারের প্রথম মেয়াদে আমি তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব তৈরি করা শুরু করি। মোদির মন্তব্যে তিনি হতাশ হয়েছিলেন কি-না, প্রতিবেদক আবারও তা জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি হয়তো এমনই মনে… প্রশ্নটা বরং তাকেই (মোদি) করুন না।
একটু ঘুরিয়ে একই প্রশ্ন আবার করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, দেখুন, আমি হতাশ নই। … কারণ অনেক সময় পুরুষরা অনেক কথাই বলে, তবে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমি যে সাহস দেখিয়েছি, অনেক পুরুষও তা দেখাতে পারেনি। আমি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি হয়তো এরই প্রশংসা করতে চেয়েছেন।
ভাগনি টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় কেমন লাগছে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ওর জন্য গর্বিত। ও দারুণ করেছে। পার্লামেন্টে টিউলিপের ভাষণ শোনার বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা ভাগনির প্রশংসা করে বলেন, ওর কণ্ঠস্বর আর কথা বলার ভঙ্গি অসাধারণ। ও একদিন বড় নেতা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *