তত্ত্ব তথ্য ইতিহাস

মৌলবাদ >>Fundamentalism

ধর্মীয় মৌলবাদ এমন একটি প্রপঞ্চ যা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশের মনস্তত্ত্বে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ কেবল পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সমস্যাসমূহের সামগ্রিক সমাধানের অপরিবর্তনীয় দিক-নির্দেশিকা। তারা স্ব স্ব ধর্মমত অনুসারে আদি ও অকৃত্রিম ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। নিরঙ্কুশ ধর্মীয় বিধি-বিধান কার্যকর করা এবং নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়ও তারা প্রয়াসী।
আধুনিক ‘মৌলবাদ’ বিশেষণটির উৎপত্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৯৫ সালে নায়াগ্রা বাইবেল সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রথম Fundamentalist হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ওই সম্মেলনের পর বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোড়া প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় খ্রিস্টধর্মের মৌলিকত্ব রক্ষার লক্ষ্যে এক আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা তাদের বিশ্বাস মোতাবেক Fundamentalism শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেন। ১৯১০ সালে লসএঞ্জেলেস বাইবেল সোসাইটি (BIOLA বর্তমানে Biola University) আরএ টোরি (RA Torrey) মিল্টন এবং লেম্যান স্টুয়ার্ড-এর সম্পাদনায় ‘The Fundamentalists’ নামে ৫টি বিষয়ে ১২টি সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় রক্ষণশীল প্রোটেস্ট্যান্ট প্রেজবিটারিয়ান যাজক, শিক্ষাবিদ, ধর্মতত্ত্ববিধ এবং প্রিন্সটন ধর্মতাত্ত্বিক সেমিনারিদের দ্বারা। এই মৌলবাদীদের মদদ জোগায় আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীল সদস্যগণ। এই আন্দোলনের পুরোধামের অন্যতম লেম্যান স্টুয়ার্ড (Layman Steward) ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিয়ন তেল কোম্পানির (বর্তমানে টহরপড়ষ হিসেবে পরিচিত) সভাপতি ও যৌথ প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫০ সালের আগে পর্যন্ত ইংরেজি Fundamentalism শব্দটি অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই শব্দটি ১৯৮৯ সালের অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে ইহুদিদের মধ্যে মৌলবাদ, জায়নবাদ ও সর্বশেষ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। ইহুদিরা মনে করে প্যালেস্টাইন ভূখ-ে একটি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ওল্ড টেস্টামেন্টে লেখা আছে। মৌলবাদ শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ১৯৭৯-৮০ সালে আয়াতুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকে। ‘ইসলামি মৌলবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। খ্রিস্টান মৌলবাদের অনুসরণে সাধারণভাবে রক্ষণশীল ইসলামি আন্দোলনকে ‘মৌলবাদের ইসলামি ভাষ্য’ হিসেবে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে ২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার পর মৌলবাদ শব্দটির সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিবাদ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ শব্দযুগলও যুক্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ইসলামি জঙ্গি মৌলবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব অবসানে যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তানসহ সারাবিশ্বের ‘জিহাদি’ মৌলবাদীদের একত্রিত করে, যুদ্ধের ট্রেনিং, অস্ত্র ও অর্থ জোগায়। তারাই আল-কায়দা এবং তালেবানি সশস্ত্র জঙ্গিদের মদদ জুগিয়ে গড়ে তোলে। তবে ভাবাদর্শগতভাবে আধুনিক ইসলামি মৌলবাদের উৎপত্তি প্রথমে আরবে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়ে। এখনও ওয়াহাবি মতবাদই হচ্ছে ইসলামি মৌলবাদের বিপজ্জনক উৎস। তবে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে আধুনিক মৌলবাদের জনক আবুল আলা মওদুদী। মওদুদীই সাম্প্রতিক বিশ্বে মুসলমানদের কাছে জিহাদের আবশ্যকতা তুলে ধরেন। এবং জিহাদের মূল কথা যে সশস্ত্র সংগ্রাম সেটাও তিনিই প্রথম দাবি করেন। মওদুদী তার মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। অন্যদিকে ১৯২৮ সালে হাসান আল বান্না মিসরে ইসলামি ব্রাদারহুড নামক চরমপন্থি দল গঠন করেন। পরবর্তীকালে সাঈদ কুতুব মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে আসেন। মওদুদীর মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত সাঈদ কুতুব তার চিন্তাধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র মোকাবিলা মওদুদী মতবাদের সর্বোত্তম অভিপ্রকাশ। সব মৌলবাদই জঙ্গিবাদী নয়। তবে মওদুদী মতবাদ ভাবাদর্শগতভাবে জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী।
মুসলমান মৌলবাদের মতো হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদও বিপজ্জনক। হিন্দুত্ববাদের দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে শঙ্করাচার্যের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ। দয়ানন্দ স্বরস্বতী ও আর্য সমাজের প্রেরণায় এই মতবাদ বিকশিত হয়। ১৯১৩ সালে এলাহাবাদে ‘হিন্দু মহাসভা’, ১৯২৫ সালে হেডগাওয়ারের উদ্যোগে নাগপুরে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ’ (আরএসএস) গঠিত হওয়ার পর হিন্দু মৌলবাদীদের বৃত্ত গড়ে ওঠে। এই বৃত্তকে ঘিরে জনসংঘ (১৯৫১), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (১৯৬৪), শিবসেনা (১৯৬৬), ভারতীয় জনতা পার্টি (১৯৮০) এবং বজরঙ্গ দল (১৯৮৪) নিয়ে গড়ে ওঠে সংঘ পরিবার।
হিন্দু মৌলবাদের মূল কথা ভারতীয় সংস্কৃতি, হিন্দুত্ব, জাতিত্ব সমার্থক। ভারতের সকল নাগরিক জাতি পরিচয়ে হিন্দুস্তানি (ভারতীয়তা সমার্থক)। হিন্দুস্তান কেবল হিন্দুদের দেশ। অন্য যারা বাইরে থেকে এসেছে (বিশেষ করে মুসলমানরা) তারা বহিরাগত। বহিরাগতদের অতিথি হিসেবে, হিন্দু-সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এদেশে থাকতে হবে।

নূহ-উল-আলম লেনিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *