শারদীয় দুর্গোৎসব, আশুরা ও প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত
ঢাকের বাদ্য সিঁদুর উৎসবে শেষ হলো দুর্গাপূজা
শুভ বিজয়া দশমী তিথিতে দেবীদুর্গাকে বিদায় জানানো ও সিঁদুর উৎসবের মধ্য দিয়ে গত ২২ অক্টোবর শেষ হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মহালয়ার দিন ঘোড়ায় চেপে সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যরে দিকে যাত্রা করেছিলেন মা দুর্গা। চার সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে নিয়ে পাঁচ দিন মর্ত্যে ভক্তদের মধ্যে কাটালেন, পূজা নিলেন। আর ২২ অক্টোবর দোলায় চেপে সন্তানদের নিয়ে আবার কৈলাসধামে ফিরে গেলেন স্বামীগৃহে।
পঞ্জিকা অনুসারে এই বছর মহানবমী ও বিজয়া দশমী তিথি পড়েছিল একই দিনে। ম-পগুলোতে তাই পূজারিদের দম ফেলার ফুরসত ছিল না। ২২ অক্টোবর সকাল ৭টা ৩৩ মিনিটের মধ্যে মহানবমী তিথির লগ্ন শেষ হয়ে যায়। এর আগেই শেষ করতে হয় মহানবমী বিহিত পূজা। এর পরপরই শুরু হয় দশমী বিহিত পূজার লগ্ন। এ সময় ষোড়শ উপাচারে দুর্গতিনাশিনীর পূজা করা হয়।
দশমী তিথির শেষ সময় সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের আগে শেষ করা হয় দুর্গাপূজার সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতা, দর্পণ বিসর্জন। দেবীদুর্গার সামনে একটি জলভর্তি পাত্রে আয়না রেখে তাতে মায়ের প্রতিচ্ছবি আনা হয়। আর এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় শাস্ত্রমতে পূজার আনুষ্ঠানিকতা।
দর্পণ বিসর্জনের পর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় সিঁদুর উৎসব। আয়স্থ হিন্দু নারীরা মায়ের পায়ে সিঁদুর দিয়ে তাদের ভক্তি জানান। এরপর মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলা আর মিষ্টিমুখ করানোর উৎসবে। মন্দির প্রাঙ্গণে তখন বাঁধভাঙা আনন্দ।
শাস্ত্র অনুসারে দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও প্রতিমা বিসর্জন হয় ২৩ অক্টোবর। মহানবমী ও বিজয়া দশমী তিথি একই দিনে হওয়ায় ভক্ত ও দর্শনার্থীরা যেন প্রতিমা দর্শনে বঞ্চিত না হন, এ জন্য পূজা উদযাপন পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো রাজধানীর অন্য ম-পগুলো এবং সারাদেশে একইভাবে ২২ অক্টোবর দুর্গাপূজার সব শাস্ত্রীয় আচার শেষ হয়েছে। রাজধানীর ২২৫টি ম-পসহ উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সারাদেশে পূজাম-পের সংখ্যাও বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে ৬৮৭টি বেড়ে এবার সারাদেশে ২৯ হাজার ৭৪টি ম-পে দুর্গাপূজা হয়েছে।
২১ অক্টোবর মহাষ্টমীর দিন রাজধানীর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনসহ দেশের অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ অক্টোবর সপ্তমীর দিন রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনে দুর্গোৎসব পরিদর্শন করেন।
সন্ত্রাসী হামলা উপেক্ষা করে পবিত্র আশুরা উদযাপন
হোসেনি দালানে বোমা হামলা সত্ত্বেও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে গত ২৪ অক্টোবর সারাদেশে পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে ওই দিন সকালে রাজধানীর হোসেনি দালানের ইমামবাড়া থেকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল বের হয়। এই মিছিলে ধর্মমত নির্বিশেষে হাজারও মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাজিয়া মিছিল দর্শনে পথের দুপাশে ছিল লাখো মানুষের ঢল। সন্ত্রাসীদের বোমা হামলার জবাব এভাবেই দিয়েছে শান্তিপ্রিয় ঢাকাবাসী। শোক মিছিলটি হোসেনি দালান ইমামবাড়া থেকে শুরু হয়ে বকশীবাজার, উর্দু রোড, লালবাগ চৌরাস্তা হয়ে শহীদের মাজার ও আজিমপুর দিয়ে ধানমন্ডি জিগাতলায় গিয়ে শেষ হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ত্যাগ ও শোকের প্রতীক হিসেবে কারবালার শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করতে গিয়ে এবারই প্রথম রাজধানীর হোসেনি দালানে ঘটেছে বোমা হামলার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বের হওয়া তাজিয়া মিছিলে গ্রহণ করা হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আশুরার শোক ও স্মৃতিকে স্মরণ করেছে শিয়া সম্প্রদায়। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল তাজিয়া মিছিল, বিশেষ মোনাজাত, দোয়া মাহফিল ও কোরআনখানি। দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরে সব মতের মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে ওয়াজ মাহফিল ও দোয়ার আয়োজন করে। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.) কারবালার ফোরাত নদের তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। হোসেনি দালান থেকে বের হওয়া তাজিয়া মিছিল ছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মগবাজার থেকে আশুরার মিছিল বের হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে যথাযোগ্য মর্যদায় তাজিয়া মিছিল বের হয়।
জাহাজ ভাসান ও ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত
প্রবারণা পূর্ণিমা
গত ২৭ অক্টোবর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা পালিত হয়েছে। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় বর্ষাবাস সমাপনের আনুষ্ঠানিকতাকেই বলা হয় প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাস দেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে শুরু হয় কঠিন চীবর দানোৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানমালায় ছিল জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, ভিক্ষুসংঘের প্রাতঃরাশ, মঙ্গলসূত্র পাঠ, বুদ্ধপূজা, পঞ্চশীল ও অষ্টাঙ্গ উপসথ শীল গ্রহণ, মহাসংসদান, ভিক্ষুসংঘকে পি-দান ও অতিথি আপ্যায়ন, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ, আলোচনা সভা, প্রদীপ পূজা, আলোকসজ্জা, বিশ্বশান্তি কামনায় সম্মিলিত বুদ্ধোপাসনা, ফানুস উড্ডয়ন, জলে জাহাজ ভাসান ও বুদ্ধ-কীর্তন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির বৌদ্ধমন্দির ও বিহারগুলোতে পূজা-পার্বণ, প্রদীপ প্রজ্বলন, ফানুস উড়ানোসহ ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক নানা কর্মসূচি পালিত হয়।