প্রতিবেদন

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টায় ফ্রিডম পার্টির ১১ জনের ২০ বছর কারাদণ্ড

গত ২৯ অক্টোবর প্রায় তিন দশক আগে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা দুটি মামলায় বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার আবদুর রশীদসহ ফ্রিডম পার্টির ১১ নেতাকর্মীর প্রত্যেককে ১০ বছর করে মোট ২০ বছরের কারাদ- দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা দুটির এ রায় দেন।
১৯৮৯ সালে হত্যাচেষ্টার এ ঘটনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তখন গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। মামলা তদন্ত করে পুলিশ হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনের দুই ধারায় অভিযোগপত্র দেয়।
রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র, প্ররোচনা ও অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। রায়ের পর ১১ আসামির মধ্যে আটজনকে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার অন্য তিন আসামি পলাতক রয়েছেন। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং আসামিপক্ষ আপিল করবে বলে জানিয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা আর তার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ‘বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়’। একই আসামি ও ষড়যন্ত্রকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
রায়ে আরও বলা হয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে ফ্রিডম পার্টির শীর্ষ নেতারা বৈঠক করে। ফ্রিডম পার্টি গঠনের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল রশীদ, ফারুকসহ অন্যরা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আসামিরা সশস্ত্র অবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হামলা চালায়। কিন্তু ভাগ্যের জোরে তিনি বেঁচে যান। আসামিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করতে ব্যর্থ হয়।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, হামলার ঘটনায় প্রথমে সাধারণ ডায়রি করা হলেও পরে তা মামলায় রূপান্তর করা হয়। ওই এজাহার ছিল দুর্বল। কিন্তু মামলার তিন আসামি পরে আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে এসেছে যে, তারা বিভিন্ন সময়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেছে এবং সে অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে।
২৮ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্টের ওই ঘটনায় ২৯ অক্টোবর দুপুর ১২টায় ঢাকার আদালতে হত্যাচেষ্টা মামলার এবং বিকেল ৩টায় নাজিমুদ্দিন রোডে স্থাপিত আদালতে বিস্ফোরক মামলার রায় ঘোষণা করেন একই বিচারক।
হত্যাচেষ্টা মামলার ১২ আসামির মধ্যে ১১ জনকে দুটি ধারায় ১০ বছর করে কারাদ- দেন বিচারক। দুটি সাজা পর্যায়ক্রমে চলবে। একই সাথে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়। বিস্ফোরক মামলায় একই রায় ঘোষণা করেন বিচারক। দুই মামলায় সাজার মেয়াদ থেকে হাজতবাসকালীন সময় বাদ যাবে। এ ছাড়া পলাতক তিন আসামির ব্যাপারে বলা হয়, তারা যেদিন আত্মসমর্পণ করবে অথবা গ্রেফতার হবে, সেদিন থেকে তাদের সাজার মেয়াদ গণনা শুরু হবে।
রায়ে দ-প্রাপ্তরা : বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ (পলাতক), জাফর আহমেদ মানিক (পলাতক), হুমায়ুন কবির ওরফে হুমায়ুন (পলাতক), মিজানুর রহমান, শাহজাহান বালু, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, মো. সোহেল ওরফে ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ ও জর্জ মিয়া। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার অন্য আসামি হুমায়ুন কবিরকে খালাস দেন আদালত। জামিনে থাকা মিজান, ইমাম হোসেন, কাজল রায়ের জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন। জামিনে থাকা একজন আসামি শাহজাহান বালু রায়ের সময় অনুপস্থিত ছিল। কারাগারে থাকা মামুন, সোহেল, মুরাদ এবং জর্জ মিয়াকেও হাজির করা হয়। রায়ের পর তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ সদস্যকে দ- বিধি ১২০(খ) এবং ৩০৭ ধারায় ১০ বছর করে দুই ধারায় মোট ২০ বছর করে কারাদ- দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা অন্য মামলায় ১১ আসামির যাবজ্জীবন কারাদ- দেন আদালত। আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, এই দুই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। খালাস পাওয়া হুমায়ুন কবির ওরফে কবিরের আইনজীবী এএসএম গোলাম ফাত্তাহ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রেক্ষাপট : এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ঘটনার সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। এ ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম মামলা করেন, পরে তা মামলায় রূপান্তর হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে এবং হামলাকারীরা সে সময় ‘কর্নেল ফারুক-রশীদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়। ওই মামলায় ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, তদন্তে অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এরপর মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খালেকউজ্জামান আদালতে দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতৃত্বে গঠিত দল ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মীরাই শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলা চালিয়েছিল বলে তদন্তে উঠে আসে।
২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে ফের বিচার কাজ শুরু হয়। ২৭ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ার পর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলেও সাক্ষীরা হাজিরে বিলম্ব করায় বিচার কাজ ঝুলে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মামলার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান ও মেজর বজলুল হুদার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ দুই মামলা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়। অন্য দুই আসামি রেজাউল ইসলাম খান ফারুক ও লিয়াকত হোসেন কালার মৃত্যু হলে তাদের নামও বাদ দেওয়া হয়।
এরপর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মামলার নথি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। তিনজন বিচারকের হাত ঘুরে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির গত ১৬ অক্টোবর দুই মামলার যুক্তিতর্ক শুনে রায়ের জন্য ২৯ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। মামলাটি ৬৬ কার্যদিবস বিচার কাজ চলে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে কেউ সাক্ষ্য দেয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় মোট ১৯ বার চেষ্টা চালানো হয়। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে হামলার মামলাটিতে চলতি বছর ২০ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন আদালত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *