সকল অপরাধী ও চক্রান্তকারীদের বিচার হবে
মুজিবনগর দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যার চেষ্টার ঘটনা তুলে ধরে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যারা চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, যারা এতিমের টাকা মেরে খায়, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে তাদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হবে। শত কথা বলেও এই বিচার বন্ধ করা যাবে না। আমরা যেখানে অন্যায় দেখি, সেখানেই তার প্রতিকার করি, ব্যবস্থা নেই। আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই না, দেবও না। ন্যায়-নীতি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করব এবং সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব। কোনো অপশক্তিই এই অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারবে না।
সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, অপরাধীকে গ্রেফতার করলেও অপরাধ হয় এখন! যদি অপরাধীকে গ্রেফতার করলেই অপরাধ হয়, তা হলে এদেশে বিচার কী করে হবে? তা হলে দেশে কোনো হত্যার বিচার কী করে হবে? ষড়যন্ত্র করলে তাদের কিছু করা যাবে না? তিনি বলেন, তারা শুধু সাংবাদিক দেখল, দেখল না অপরাধী। ষড়যন্ত্রও হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে, আর সমালোচনারও শিকার আমরা। সবার মানবাধিকার আছে, আমাদের কোনো মানবাধিকার নেই। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর যারা মানবাধিকারের কথা বলেন, তাদেরই লজ্জা হওয়া উচিত। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য সাংবাদিকদের মায়াকান্না দেখছি, যারা মায়াকান্না করছেন, তাদের তা হলে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।
১৭ এপ্রিল দেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের দিন ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে গত ১৮ এপ্রিল বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমেরিকাই জয়কে অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ধরেছে, বিচার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তেই সেটা ধরা পড়েছে। সেখানে যাদের সাজা হয়েছে, আদালতে তাদের বয়ান থেকেই এসেছে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের নাম। এটা আমাদের করা না, আমেরিকার কোর্টে প্রমাণিত। যারা এত বড় ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত তাদের গ্রেফতার করা হলেই এত নিন্দা, অথচ ষড়যন্ত্র যে করল তাকে নিন্দা করেন নিÑ এটা কোনো ধরনের সাংবাদিকতা? যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের জন্য এত মায়া কান্না, আর যারা ভিকটিম তাদের কী কোনো অধিকার নেই? যারা ষড়যন্ত্র করে, যাদের নাম বিদেশের কোর্টে উঠে এসেছেÑ তাদের পক্ষে যারা কথা বলে আসলে তাদেরই লজ্জা হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এলে তাদের মূল লক্ষ্য থাকে অর্থ লোপাট। আর সে অর্থ তাদের এত পরিমাণে রয়েছে যে, তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইকে ঘুষ দিয়ে ভাড়া করে ফেলেছে। কী কারণে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়) অপহরণ করে হত্যা করতে হবে। সেই ষড়যন্ত্রে তারা জড়িত (শফিক রেহমান), এটাও কিন্তু ধরা পড়েছে আমেরিকায়। আমেরিকাই ধরেছে, তারাই বিচার করেছে, আর তাদেরই বয়ানেÑ কোর্টে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে সেখানেই এদের নাম এসেছে। এগুলো আমাদের করা না, আমেরিকার কোর্টে প্রমাণিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরাধীকে গ্রেফতার করলে যদি অন্যায় করা হয়, তা হলে এরা আর কোনোদিন হত্যাকারীদের বিচার চাইবে না। অপরাধীদের বিচার চাইবে না। একজন সাংবাদিককে দেখবে, তার অপরাধটা দেখবে না? আর এটা আমাদের দেশে হয়নি, আমেরিকায় হয়েছে, তাদের দেশ ও কোর্টে হয়েছে। তা হলে তাদের সাথে বোঝাপড়া করলেই হয়। যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, আমার প্রশ্ন জাগে, যখন আমার বাবা-মা ছোট্ট ভাইকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না। তার মানে আমাদের কেউ মারা গেলে, কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে বিচার চাওয়া যাবে না। তবে আমাদের কী কোনো মানবাধিকার নেই? আমাদের কী বাঁচার অধিকার নেই। আমরা কী কোনো মানুষ না? ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেফতার করলে, যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের সমর্থন করবে? দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। আওয়ামী লীগের লোক মারা গেলে বিচার হবে না? তা হলে কোনো কিছু ঘটলে বা মানুষ মারা গেলে বিচার চায় কেন? তিনি বলেন, আমার কাছে অবাক লাগে যখন দেখি একজন ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটা নিয়ে অনেক কথা। তা হলে কার আছে বিচার চায়? সকলের মানবাধিকার থাকবে, শুধু আমাদের থাকবে না কেন? আমরা যেখানে অন্যায় দেখি, সেখানে ব্যবস্থা নেই। আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই না, দেব না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, ডা. দীপু মনি এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি, সুজিত রায় নন্দী, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ এমপি, সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাত ও সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এমপি ও অসীম কুমার উকিল।
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার প্রত্যয়
মুজিবনগর দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা
দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সমুন্নত রেখে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীসহ সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালিত হয়েছে।
দেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঐতিহাসিক এই দিনটি স্মরণে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননেও জাতীয়ভাবে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। দিবসটি পালনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের জনতার ঢল নামে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকাল সাড়ে ৭টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বনানী কবরস্থানে শহীদ জাতীয় তিন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে, তাজউদ্দিন আহমদ ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। একই সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজশাহীতে আরেক শহীদ জাতীয় নেতা এএইচএম কামরুজ্জামানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এর আগে ভোর সাড়ে ৬টায় রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি শুরু হয়।
‘মুজিবনগর সরকারই দেশের প্রথম সরকার’
সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গত ১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এদিকে মেহেরপুরে মুজিবনগর আ¤্রকাননে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা সমাবেশ অনষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল শেখ হাসিনা মঞ্চের ওই অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপিসহ প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীরা বক্তব্য দেন। পাকিস্তানের বাংলাদেশ মিশনেও দিবসটি পালনের খবর পাওয়া গেছে।
আ¤্রকাননের সমাবেশে শিল্পমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বর্তমানে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালে লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এর আগেই ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করবে এবং ২০৪১ সালের অনেক আগেই দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মেহেরপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি বলেন, মুজিবনগরে শপথ নেওয়া সরকার দেশের প্রথম সরকার। তিনি বলেন, কেউ বলে মুজিবনগর সরকার, কেউ বলে অস্থায়ী সরকার, কেউ আবার বলেন বিপ্লবী সরকার। এখানে শপথ নেওয়া সরকারই দেশের প্রথম সরকার। ওই সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি বলেন, পাকিস্তানি তাঁবেদার বাহিনী রাষ্ট্রকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশ হয়েছিল ভিক্ষুকের রাষ্ট্র, হতাশার রাষ্ট্র। এর পরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে উন্নয়নের দিকে। শেখ হাসিনা জাতিকে আবার আশার আলো দেখিয়েছেন। আজকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। হানিফ বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি সেই পাকিস্তানি দোসররা আজও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আজকে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ওই খালেদা জিয়ার সব ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার শপথ নিতে হবে।
এর আগে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ পতাকা উত্তোলন করে দিবসের কর্মসূচির সূচনা করেন। পরে সকাল ১০টায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার এমপিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।