সবার আগে বাংলাদেশ
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, বাংলাদেশ সবার আগে। ভারত সব প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। গত ২৩ অক্টোবর সকালে বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনে নতুন চ্যান্সারি ভবন ও ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দেন।
সুষমা স্বরাজ প্রতিবেশীদের ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। ইংরেজি ও হিন্দিতে দেওয়া ২০ মিনিটের বক্তৃতা দর্শক শ্রোতারা তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে উপভোগ করেন। বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের অগ্রাধিকার নীতি বুঝাতে সুষমা হিন্দিতে বলেন, ‘পড়শি পেহেলে লেকিন বাংলাদেশ সবচে পেহেলে।’
ভারতীয় হাইকমিশনের চ্যান্সারি কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এমপি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয় শংকর, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী প্রমুখ। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
সুষমা স্বরাজ দুদিনের ঝটিকা সফরে ২২ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা আসেন এবং ২৩ অক্টোবর দুপুরে নয়াদিল্লি ফিরে যান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা দুজন দাদা আর দিদির সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছি।’ বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ক অসাধারণ। দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো সমাধান হবে। দুই পক্ষই বন্ধুত্বের মেজাজে সঠিক পথে কাজ করছে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি দুই দেশ মিলে সব বিষয় ইমানদারির সাথে মিটিয়ে ফেলব। ইতোমধ্যে আমরা সমুদ্রসীমা আর স্থল সীমান্ত নিয়ে বিরোধী শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি করেছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের শক্ত ভিত্তি দিয়েছেন, যা দিনে দিনে সহযোগিতার হাত ধরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগামীতে এই সম্পর্ক বৃহত্তর উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছবে, আমি নিশ্চিত।
দুই দেশের জনগণের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কয়েক বছরে জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। প্রতিবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফরে যাচ্ছেন। এ বছর ১৪ লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দেওয়া হতে পারে। ২০১৬ সালে ছিল সাড়ে ৯ লাখ আর ২০১৫ সালে সাড়ে ৭ লাখ।
তিনি আরও বলেন, দুই দেশের তরুণ সমাজই বড় শক্তি ও সম্পদ। তরুণদের ওপর বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। তরুণরাই হলো ভবিষ্যৎ। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ সজাগ ও সচেতন। তিনি সব সময় বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ নজর দিয়ে থাকেন।
ভিসা প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করার জন্য তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পরই নির্দেশ দেন। যার ফলশ্রুতিতে আজ সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত যেতে পারছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সময়ে দুদেশের সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে। বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ আর্থিক ৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১০ কোটি টাকার অনুদানে ২৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামী দুই বছরে ১১০ কোটি টাকার অনুদানে ৬০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ৭১ কোটি টাকার অনুদানে ১৫টি প্রকল্প ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবে।
অনুষ্ঠানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রীরা মনোজ্ঞ সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করে। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃত বিভাগকে কম্পিউটার, বই ও শিক্ষা সরঞ্জাম উপহার দেন সুষমা স্বরাজ।
ঝুলে থাকা ইস্যুর নিষ্পত্তিতে কাজ করে যাচ্ছি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের সাথে কাজ করবে ভারত। ভারত চায় রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। বাস্তুচ্যুত নাগরিকরা ফিরে গেলে রাখাইনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে। সেখানে দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটালে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ গত ২২ অক্টোবর বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এমপির সাথে যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক শেষে এ কথা বলেন।
দুদিনের সফরে গত ২২ অক্টোবর দুপুর পৌনে ২টায় ঢাকায় এসে বিকেলে স্থানীয় একটি হোটেলে জেসিসি’র বৈঠকে যোগ দেন সুষমা স্বরাজ। বৈঠক শেষে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে পৃথক বিবৃতি দেন।
মাহমুদ আলী তার বিবৃতিতে বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। দুই দেশের সম্পর্ক আজ এক ঐতিহাসিক নতুন উচ্চতায় উপনীত। বাণিজ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, জনগণের মধ্যে সংযোগ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ভারত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে। এ জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানাই। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া ও এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতে মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত চাপ রাখতে হবে ভারতকে।
মাহমুদ আলী তার বক্তৃতায় নিরাপত্তা, সহযোগিতা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, বিদ্যুৎ, রেল, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন।
তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে মাহমুদ আলী বলেন, গত ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়াদকালেই তিস্তা চুক্তি সই হবে বলে জানান।
সুষমা স্বরাজ তার বক্তব্যে ঝুলে থাকা অনিষ্পন্ন ইস্যুর নিষ্পত্তির কথা জানিয়ে বলেন, আমরা সেগুলো জানি। সেগুলোর সমাধানে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আজ আমরা সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদের মতো অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছি। আমরা যৌথ উদ্যোগ নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে ঘৃণা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করে সমাজকে রক্ষার পদক্ষেপ নিয়েছি। নিরাপত্তা ছাড়াও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি সাধন করেছি।
বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতা চলছে। ভারত এখন ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে সরবরাহ করছে। সিলিগুঁড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত পাইপ লাইনের মাধ্যমে পেট্রোলিয়াম পণ্য নেওয়া হবে। একটি এলএনজি টার্মিনালও স্থাপিত হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুষমা স্বরাজ বলেন, রাখাইন থেকে আসা লাখ লাখ মিয়ানমারের নাগরিককে মানবিক সহায়তার জন্য ভারত সরকার অপারেশন ইনসানিয়াত চালু করেছে। সিদ্ধ চাল, ডাল, লবণ, চিনি, তেল, চা, দুধ, সাবানসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ব্যাপকতায় ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। জনগণের কল্যাণ আর সংযম বিবেচনা করে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছি। এটা পরিষ্কার যে, বাস্তুচ্যুত নাগরিকরা ফিরে গেলেই রাখাইনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। সেখানে দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। ভারত আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে। যাতে রাখাইনে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যায়। আমরা কফি আনান কমিশনের সুপারিশ সমর্থন করি।
জেসিসির বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ভারতের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ছাড়াও পররাষ্ট্র, নৌ পরিবহন, পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ইআরডি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেন। অন্যদিকে সুষমা স্বরাজের সাথে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শংকর, ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠকের পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। সেগুলো হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও নুমালিগড় রিফাইনারির মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি।
২২ অক্টোবর দুপুরে কুর্মিটোলায় বঙ্গবন্ধু বিমান ঘাঁটিতে বিশেষ বিমানযোগে এসে পৌঁছলে সুষমা স্বরাজকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। সেখানে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করেন তারা।
২৩ অক্টোবর সকালে সুষমা স্বরাজ বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করেন। ভারত সরকারের সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন তিনি। দুপুরে বিশেষ বিমানযোগে নয়াদিল্লি ফিরে যান।