ইতিহাস : প্রবন্ধ

‘সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুশাসন ১৯৭২-৭৫’

সামছুর রহমান: টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। শৈশবে খেলাধুলা ছিল তার খুবই প্রিয় কিন্তু অসুস্থ হওয়ায় কিছু দিনের জন্য তাকে খেলাধুলা ও পড়াশোনা উভয়ই বন্ধ রাখতে হয়ে। বঙ্গবন্ধু ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা ব্যবহার করতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বরে অর্জিত চূড়ান্ত বিজয়ে তিনি জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতৃত্বের অনন্য গুণাবলি সমৃদ্ধ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্যময়, জনগণের দাবি আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয় ও আপসহীন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনই ছিল কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হওয়া নয়; বরং বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তি। ’৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেনÑ ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ বঙ্গবন্ধুর এই আপসহীন ও অবিচল দর্শনের কারণে ৩৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় ১৬ বছরই রাজবন্দি হিসেবে তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করলেও দলকে সুসংগঠিত করার জন্য ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্তে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলেও পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মূলত, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছর সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী ও সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি নব্য স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, ভারত থেকে প্রত্যাগত ১ কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধে সহায়-সম্বল হারানো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা, কর্মক্ষম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্র আমদানি এবং প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাকে চালু করা। আর এসব কর্মকা-ের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে ল’ অ্যান্ড অর্ডার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য উপযুক্ত একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বত প্রমাণ সমস্যার মধ্যে থেকেও তিনি ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তৎকালীন প্রতিটি মহকুমায় ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, মুক্তিযুদ্ধে পাক-বাহিনীর হাতে নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যায্যমূল্যের দোকান ‘কসকো’ স্থাপন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ গরিব কৃষকের ৭০ কোটি টাকা বকেয়া খাজনা মাফ, বিসিএস প্রশাসনসহ সকল ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার নিয়োগ, ভ্রাতৃপ্রতিম দেশসমূহের সহায়তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ, ফেরি, নৌযান, সমুদ্রবন্দর পুনর্নির্মাণ ও সচলকরণ। বঙ্গবন্ধুর আমলে আনা ফেরি কামিনী, কস্তুরি, করবী মাওয়া ঘাটে আজও সচল রয়েছে। স্বাধীনতা-বিরোধী কোলাবরেটরদের অপপ্রচার, সর্বহারা নামে প্রতিবিপ্লবী সংগঠনের অপতৎপরতা, কিসিঞ্জারের নির্দেশে খাদ্য বোঝাই জাহাজকে ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি এক শ্রেণির অসৎ পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন আমলাদের অসহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর চলার পথ হয়ে ওঠে সমস্যাসংকুল। এই শ্রেণির আমলারা ভারত থেকে অত্যন্ত নি¤œমানের শাড়ি কাপড় আমদানি করে সরকারকে দুর্নামে ফেলেন। এতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কালিমালিপ্ত হয়।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী একটি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তারা এখনো বনেদী আমলাতান্ত্রিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। আমরা তাদেরকে স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি, তাদের পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। আমার সরকার নব রাষ্ট্র এবং নতুন সমাজের উপযোগী করে সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রকে পুনর্গঠিত করবে।’ পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী মনে করতেন দেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজন ফার্স্ট ক্লাস সিভিল সার্ভিসের। সিএসপি ক্যাডারের সদস্যরা ছিলেন তাদের চোখে ব্লু-আইড বয় বা নীল আঁখির বালক। তাই সিএসপি ও পিএসসিরা ব্লু-ব্লাডের উত্তরাধিকারী এলিট ক্লাস হিসেবে নিজেদের গণ্য করতেন। বঙ্গবন্ধু আমলাদের এই গণবিমুখ ও স্বৈরাচারী মানসিকতাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ৪ নভেম্বর ১৯৭২-এ গণপরিষদে দেওয়া এক ভাষণে তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুশাসন দিয়ে ‘Mentality must be changed সিএসপি, পিএসপি বাংলাদেশের থাকবে না। সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে, তারা শাসক নন, সেবক। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। আইনের চোখে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার।’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনের এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলের সেই ঘুণেধরা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম দিয়ে বাংলার মানুষের মঙ্গল হতে পারে না। ইট মাস্ট গো। সেই জন্য আমূল পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে।’ বঙ্গবন্ধু তার এই চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ তিনি আরও উপলব্ধি করেছিলেন যে, সরকারি কর্মচারীর ওপর শতভাগ দায়িত্ব অর্পণ করে সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। প্রশাসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন রয়েছে। তাই সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সংযোজিত হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
দেশ ও জনগণের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব ও সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর একাধিক সুস্পষ্ট অনুশাসন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি অত্যন্ত খোলামেলাভাবে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অনুশাসন দিয়ে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তাঁরা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তাঁরা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাঁদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।’ পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ প্রদত্ত ভাষণে সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি এই অনুশাসন দেন যে, ‘সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও স্পষ্ট অনুশাসন দিয়ে বলেন, ‘এ জন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইলো, আমার অনুরোধ রইলো, আমার আদেশ রইলো, আপনারা মানুষের সেবা করুন।’
রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারাখানায় কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবসের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি আপনার কর্তব্য দেশের ও দেশের জনগণের প্রতি কতটা পালন করছেন, সেটাই বড় কথা।’ প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ২১ জুলাই ১৯৭৫-এ বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সব কিছুই যেন জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়, ইডেন বিল্ডিংস বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে, থানায়, ইউনিয়নে, জেলা পর্যায়ে এটা পৌঁছে দিতে চাই। যাতে জনগণ সরাসরি এসবের সুযোগ-সুবিধা পায়।’
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ জাতীয় সংসদে দেওয়া দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ভাষণে জুডিসিয়াল সিস্টেমের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জাসটিস ডিলেড জাসটিস ডিনাইডÑ উই হ্যাব টু মেইক এ কমপ্লিট চেইঞ্জ এবং সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সাথে সাথে বিচার পায়।’
বঙ্গবন্ধু, সরকারের উচ্চ ও নি¤œ বেতনভোগী কর্মচারীদের বেতনের ক্ষেত্রে যে বিরাট ব্যবধান ছিল তা কমিয়ে আনতে ‘সার্ভিসেস রি-অর্গানাইজেশন কমিটি’ গঠন করেন। সরকারি চাকরিতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের যে ১২৫ ও ৩৩টি ধাপ ছিল তার অবসান ঘটিয়ে ৮টি ধাপ চালু করেন। তার ভাষায়Ñ ‘মাত্র ৭ আসমান অর্থাৎ ৭টি স্তরÑ এর বেশি স্টেপ সরকারি চাকুরিতে থাকবে না।’ গরিব কর্মচারীরা যাতে বেঁচে থাকার মতো সম্মানজনক বেতন-ভাতাদি পান সে প্রসঙ্গে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘কেউ ৭৫ টাকা বেতন পাবে, কেউ ২ হাজার টাকা পাবে তা হতে পারে না। সকলের বাঁচবার মতো অধিকার থাকতে হবে।’ প্রশাসনে সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মাপকাঠি কি হবে উক্ত বক্তব্যে সে বিষয়েও তিনি উল্লেখ করেন, ‘আজ যে কাজ করবে এবং লোকে তাঁকে কতটুকু ভালোবাসে তার ওপর নির্ভর করবে তার প্রমোশন। প্রমোশনের ব্যাপারে গরিব, অল্প বেতনভোগী কর্মচারীদেরও অধিকার থাকবে।’
যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গত মানুষের সেবায় সর্বশক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধু দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ন্যায্যমূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিতরণ, কৃষককে বিনে পয়সায় সার প্রদান, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখাসহ খাদ্য আমদানির মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা তিনি চালিয়ে যান। কিন্তু এসব কার্যক্রমের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশেরই ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সে প্রচেষ্টাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করে, যা বঙ্গবন্ধুকে প্রচ-ভাবে ব্যথিত করে তোলে। সেই সময়ের বিভিন্ন বক্তব্যে ও ভাষণে বারংবার এ প্রসঙ্গে তিনি আলোকপাত করেন এবং অত্যন্ত পরিতাপের সাথে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বলতে বাধ্য হনÑ ‘এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।’ এ প্রসঙ্গে তার আরও স্পষ্ট অনুশাসন ছিল যে, ‘সামরিক ও অসামরিক সকল পর্যায়ের সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আমার আহ্বান ও নির্দেশ, তারা যেন সৎ পথে থেকে নিঃস্বার্থভাবে তাঁদের কর্তব্য পালন করেন এবং দুর্গত মানুষের সেবা করে যান।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগে পুলিশ সপ্তাহে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। দুর্নীতিবাজদের খতম করবÑ আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো।’
সাধারণত অনেক কর্মকর্তা মনে করেন যে, তার দায়িত্ব শুধু তার বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু জনগণের কল্যাণে এবং সার্বিক উন্নয়নে আন্তঃবিভাগের মধ্যেও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কর্মকর্তাদের এই সাইকোলজিও বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মচারীদের সতর্ক করে বলেন, ‘সকলকে এক লক্ষ্যে, এক প্রেরণায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার্থে যুক্তরাজ্যে ছিলেন। এই সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসাধীন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ত্রাণকার্যের জন্য টাকা বড় প্রশ্ন নয়, জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ কার্য চালান।’ তিনি তৎকালীন মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে বন্যাদুর্গত এলাকায় অবস্থান করে ত্রাণকার্য পরিচালনার এবং প্রয়োজনে ত্রাণকার্যের জন্য বিমানসহ সকল প্রকার পরিবহনকে কাজে লাগানোর নির্দেশ দেন।
সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই তিনি যেমন জনগণের পাশে ছিলেন, তেমনি জনগণও সবসময়ই তার পাশে থেকে তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশাই বঙ্গবন্ধুর হৃদয়কে স্পর্শ করেছে বেশি। যুদ্ধ-উত্তর সমস্যাবলির সমাধানের পাশাপাশি তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এর প্রত্যেকটি ছিল গণমুখী এবং জনগণের কল্যাণে শোষণ-বঞ্চনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে। মাত্র ৯ মাসে তিনি জাতিকে দিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা শাসনতন্ত্র ‘বাংলাদেশের সংবিধান’। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বিনা মূল্যে এবং স্বল্প মূল্যে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক আর কৃষকের জন্য সার ও কৃষি উপকরণ বিতরণ, ইসলামের ওপর গবেষণার জন্য ইসলামি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা, ৫৮০টি শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, স্বল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি ও সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের অন্যতম সাফল্য। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি যে মুহূর্তে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নিশ্চিত করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে নিষ্ঠুর ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাকে জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়।
খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করলেও তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও আদর্শকে হত্যা করতে পারে নাই। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রে সার্বিক মুক্তির মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তা বঙ্গবন্ধু-কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন ও আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হতে সমর্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ কালের আবর্তে আজ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে e-governance প্রতিষ্ঠা করে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের মাধ্যমে কম খরচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণকে তার ইস্পিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হলে ‘সরকারি কর্মচারীরা শাসক নন, তারা সেবক’ বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত অনুশাসন বাস্তব অর্থেই প্রতিপালিত হবে। ‘শাসক নয় জনগণের সেবক হিসেবে দেশের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাবে’ শোকের এ মাসে শোককে শক্তিতে পরিণত করে সরকারি কর্মচারী হিসেবে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

[দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের যুগ্ম সচিব ও পরিচালক (প্রশাসন) সামছুর রহমান কর্তৃক সংকলিত এ প্রবন্ধটি বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে অধিদফতর কর্তৃক আয়োজিত শোকসভায় মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত হয়, যা উত্তরণ-এর সহায়তায় সংগৃহীত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *