সেদিনের একটি ঘোষণায় ভেঙ্গে যায় সারা বাংলার সব স্তব্ধতা
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ছিল আলো ঝলমলে একটি দিন। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। পাকিস্তান জাতীয় দলের বিরুদ্ধে একটি অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচে খেলতে নামে কমনওয়েলথ একাদশ।
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার বাসিল ডি’ওলিভেরাকে ঘিরে। কারণ গায়ের রং কালো হওয়ায় তিনি কখনো দেশের হয়ে খেলতে পারেননি। সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিল বর্ণবাদ।
কিন্তু খেলা শুরু হলে সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে পাকিস্তানী ওপেনার রকিবুল হাসানের উপর। সে সময়ে পাকিস্তান জাতীয় দলে প্রথম বাঙ্গালী খেলোয়াড় ছিলেন রকিবুল হাসান। ক্রিজে নেমে ‘জয় বাংলা’ লেখা নিজের ব্যাটটি দেখালে স্টেডিয়ামের দর্শকরা যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।
১ মার্চ ম্যাচের তৃতীয় দিনের খেলা চলছিল। পাকিস্তান দল দ্বিতীয় ইনিংস খেলছিল এবং কোন সিদ্ধান্তের লক্ষণ না থাকায় ম্যাচে কিছুটা উত্তেজনা ছিল। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে অবরুদ্ধতা থাকলেও আন্তর্জাতিক এ ম্যাচটিকে কেন্দ্র করে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল। বিশেষ করে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে একজন বাঙ্গালী খেলছেন এটাই ছিল সেদিন সবচেয়ে বড় পাওয়া। বাঙ্গালী জাতির জন্য এটা ছিল অনেক বড় একটি দিন।
স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ভূমি ধস বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩শ’ আসনের মধ্যে ১৬২ এবং প্রাদেশিক সভায় ৩শ’ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পায় দলটি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দলটি জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বৃহত্তম দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি থেকে ঝামেলা পাকাতে শুরু করে যে ঢাকাতে অধিবেশন (৩ মার্চ ১০৭১ নির্ধারিত ছিল) শুরু হলে তারা সেটা বর্জন করবে।
ভুট্টো উর্দু ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘এটা হবে পশ্চিম পাকিস্তানী সংসদ সদস্যদের জন্য কসাই খানা। এ অধিবেশনে যোগ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানী সংসদ সদস্যদের পা ভেঙ্গে দেয়া হবে বলেও হুমকি দেন তিনি।
গর্বের সঙ্গে ভুট্টো উচ্চারণ করেন যে, ‘সিন্ধু এবং পাঞ্জাব হলো পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ এবং ‘তাদের প্রতিনিধি ছাড়া কোন সরকার হতে পারেনা।’
জতীয় পরিষদের তিনশ’ আসনের মধ্যে মাত্র ৮২টি আসন ছিল ভুট্টোর দখলে। পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাকে ছাড়া এ্যাসেম্বলি বসা মানেই সেটা হবে ডেনমার্কের প্রিন্স ছাড়া হ্যামলেট নাটকের মঞ্চায়নের মত।’
মুলত পাকিস্তানকে শাসন করছিল সেনাবাহিনী এবং তারাই সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। তবে এমন ফল তারা প্রত্যাশা করেনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরই রাষ্ট্রপতি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে একত্রিত হয়ে ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে একটি চুক্তিতে আসে। রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বিকেলে ইসলামাবাদ ফিরেন এবং ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি বাতিল ঘোষণা করেন।
স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ভক্তরা বেতারে তার এমন বক্তব্য শুনে মুহূর্তের মধ্যে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সবাই একযোগে স্টেডিয়ামের ছড়িয়ে পড়ে খেলাটি ভন্ডুল কের দেয়। তারা স্টেডিয়ামের প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ফলে খেলোয়ড়রা মাঠ ছেড়ে প্রাণ ভয়ে গিয়ে দৌড়ে প্যাভিলিয়নে আশ্রয় নেয়।
বিক্ষুদ্ধ জনতা স্টেডিয়াম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে রওনা হয় এবং যাবার পথে হাইকোর্টের সামনে ও কার্জন হলের সামনের কাটা তারের বেড়া ভেঙ্গে ফেলে।
সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা সেখানে গিয়ে শ্লোাগান দিতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সারা বাংলা যেন বিক্ষোভের এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাইরে চলছে বিক্ষুব্ধ বাঙালীর কঠোর কর্মসূচির দাবিতে মুহুর্মুহু শ্লোগান। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন।
সন্ধ্যায় জারি করা হয় কার্ফু। হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বালাবেন না। যদি জ্বালান, সে দাবানল হতে আপনারাও রেহাই পাবেন না।…সাবধান, শক্তি দিয়ে জনগণের মোকাবেলা করবেন না।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষক গোষ্ঠির নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দুই যুগের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের হাত ধরে ৭ মার্চ ঘোষিত হয় বাঙ্গালী মুক্তি সনদের অমর কাব্য , “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”’। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা শুরু করলে মূহূর্তেই গর্জে উঠে বাঙ্গালী, ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধে। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বর মানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।