‘সোনার বাংলা’ স্বপ্ন নয়
এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দৃঢ় হাতে হাল ধরে তিনি নৌকা ভাসিয়েছিলেন স্বপ্ন পূরণের পথে।
কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি, শকুনেরা ওত পেতে ছিল, সুযোগ বুঝে বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয় জাতির জনকের বুক, ছিন্নভিন্ন করে দেয় সেই স্বপ্নের মানচিত্র। তারপর দশকের পর দশক ধরে চলে অন্ধকারের রাজত্ব।
তবে দিন আজ বদলেছে। অন্ধকার ফুঁড়ে আবার আলো ফুটে উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ আর কেবল কল্পনা নয়, অনেকটাই বাস্তব।
সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৪৫ বছর আগের সমৃদ্ধ পাকিস্তানকেও পেছনে ফেলে এগিয়েছে বাংলাদেশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে বড় সফলতা দেখানো বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার নামছে দ্রুত হারে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। ৭ শতাংশের ঊর্ধ্বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
১৭৫ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ এখন এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উন্নয়নে আগ্রহী অন্য দেশগুলোর সামনে বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে ধরে তা অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছে।
শুধু অর্থ খরচ করার সামর্থ্যই নয়, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমিক, কৃষক—সর্বস্তরে উত্পাদনশীলতা ও দক্ষতার উন্নতি ঘটছে। এসবের মধ্য দিয়েই কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাঁরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না দারিদ্র্য, থাকবে না বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতি। অগ্রসরমান একটি দেশ হিসেবে অভ্যুদয় ঘটবে বাংলাদেশের। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই কাজ করছে সরকার।
সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতেই প্রণীত হয় বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা; যেখানে কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির শিল্প উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই স্বপ্ন সামনে রেখে বর্তমানে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কাজ করছে সরকার। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সরকার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। দৃশ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সূচকের অগ্রগতির সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বেকারত্ব দূর করা, দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলা এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সর্বস্তরে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেই সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করছেন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর দেশ উন্নতির দিকে পরিচালিত হচ্ছিল। তবে তার ধারাবাহিকতা থাকেনি। ২০০৯ সালে আবার বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০১৪ সালেও পুনর্নির্বাচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। টানা আট বছর সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশের চিত্র বদলে যায়। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সামাজিক অনেক সূচকে আমরা এগিয়ে রয়েছি। মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে ইতিমধ্যেই আমরা শামিল হয়েছি। জাতিসংঘের কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি রয়েছে মাত্র। এখন বাংলাদেশ আর ক্ষুধার্তের দেশ নয়। সমস্যাসংকুল বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের পণ্য ও জনশক্তি রপ্তানি প্রশংসনীয়। শিক্ষার প্রসার ও নারীর মুক্তি অভূতপূর্ব গতিতে চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ৪৫ বছর আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ, যা এখন ২২ শতাংশের একটু বেশি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তাঁর নির্দেশনায় বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বই গড়ব। ’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণের পথে অন্যতম প্রধান বাধা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতার অভাব। আরো অন্তরায় ছিল বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ, বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার অভাব, বেকারত্ব, অপ্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি এবং উদ্ভাবন ও উদ্যোগের অভাব। এসব প্রতিবন্ধকতার অনেক কিছুই দূর করে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়েছে। সরকারের বিনিয়োগ যথেষ্ট বেড়েছে। আট বছরে বাজেটের আকার ৯৪ হাজার কোটি টাকা থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময় ধরে প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ হারে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন (তিন হাজার ১০০ কোটি) ডলারে উঠেছে। রপ্তানি বেড়েছে বছরে ১০ শতাংশেরও বেশি হারে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর জন্য সরকার কাজ করছে। ২০২০ সাল নাগাদ আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৮-এর ওপরে নিতে হবে। জ্বালানি সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, তবে ২০১৮ সাল নাগাদ তা উতরে যাবে। বছরে যে পাঁচ লাখ করে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে, তা ধরে রাখতে হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২০ কোটি। গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের এখন যে আগ্রহ, তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। নিকট ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত থাকলে পল্লী অর্থনীতিতে গুরুত্ব আরো বাড়বে। ’
উন্নয়নে সন্তোষজনক অগ্রগতি হওয়ায় সরকার গতকাল সোমবার থেকে সারা দেশে উন্নয়ন মেলার আয়োজন করেছে, যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গত আট বছরে নানা ক্ষেত্রে অর্জিত নানা সাফল্য তুলে ধরছে। সেখানে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিকবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রো রেল প্রকল্প, পায়রা ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোকে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় সরকারের সাফল্য ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথাও জায়গা পেয়েছে সেখানে।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ওই মেয়াদের প্রথম অর্থবছরে বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিদ্যুৎ বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ দিত অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র আট বছরের মাথায় বর্তমানে দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ উত্পাদনের ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।
সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এসেছে। এক দশক আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের বাজেটের আকার ছিল ৬৪ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা এখন তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায় উঠেছে। সে সময় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা এখন এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বড় সাফল্য রাখা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে খরচের পরিমাণ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ১৬ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। ১০ বছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছয় গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা এখন দুই লাখ ৪২ হাজার ৪০২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে সরকারের ঋণ জিডিপির অনুপাতে কমেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাত ছিল ৪৩ শতাংশেরও বেশি, যা এখন ৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
সরকারের রাজস্ব খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি প্রকৃত খাতেও (রিয়াল সেক্টর) এই সময়ে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি অর্জিত হয়েছিল দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ সরবরাহ বাড়ার কারণে। তারপর ৪০ বছর পর প্রকৃত উত্পাদনশীলতার ভিত্তিতে গত অর্থবছর প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ঘর স্পর্শ করেছে। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৭.৫ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপির আকার ছিল চার লাখ ৮২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণ ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে এক হাজার ৪৬৫ ডলার হয়েছে। খাদ্যশস্যের উত্পাদন দুই কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টন থেকে বেড়ে হয়েছে তিন কোটি ৯০ লাখ টন। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে গত অর্থবছর শেষে ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন (তিন হাজার ৪২০ কোটি) ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমদানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছর শেষে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন (এক হাজার ৪৯০ কোটি) ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এসডিজি বাস্তবায়নে মুখ্য সমন্বয়ক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা বলতে এমন বাংলাদেশ চেয়েছেন, যেখানে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, পরনের কাপড় পাবে, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হবে, সারা পৃথিবীর তুলনায় এগিয়ে যাবে। এসডিজি বাস্তবায়নের সঙ্গে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার ব্যাপারে সরকারের নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছে না, সরকার ও সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতাও বাড়ছে। রাজস্ব আয় বাড়ায় পরনির্ভরশীলতা কমছে, পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থে বাস্তবায়নে সাহস দেখিয়েছে। শুধু অর্থের জোগান দেওয়াই নয়, দক্ষভাবে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতাও অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছেন উল্লেখ করে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘একটা দেশ ততখানিই এগোয়, যতখানি রাজনৈতিকভাবে আগায়। বাংলাদেশে যেটুকু অর্জন, তা রাজনীতির। বর্তমান সরকার বিভিন্ন নীতির মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে নির্দেশনা দেন, সরকারি কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করেন। ’
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে, রাজনৈতিকভাবে ততটা পিছিয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারত, পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অন্য অনেক দেশের চেয়েও স্থিতিশীল আছে। কথিত ৯৩ দিনের অবরোধ ও সন্ত্রাসী কিছু ঘটনা বাদ দিলে বাংলাদেশ অনেকটাই স্থিতিশীল। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের ভাবনার মূলে ছিল দেশের মানুষের উন্নতি, তাদের থাকা-খাওয়া আর পরার ব্যবস্থা করা; মানুষ যেন ভালো থাকতে পারে, ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’-এর মধ্যে শুধু রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়টি ছিল না, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। ৭৮ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কৃষকের সন্তান। তাঁরা কৃষির উন্নতি আশা করেছিলেন। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিতে তিনি এসেছিলেন, অনেকটা সফলও হয়েছিলেন মাত্র চার বছরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো ঠিক করে ফেলেছিলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাও এসেছিল। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। ”
ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘এত অল্প সময়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, গ্রামের মানুষের হাতেও অর্থ আছে। শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিনে ৭০০ কোটি টাকা শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে। শিল্প খাতে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটছে। বাংলাদেশ এখন সবুজ উন্নয়নের দিকে ঝুঁকছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিকবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবু নগরে গরিব মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি রয়ে গেছে। এদিকে সরকারের নজরও আছে। উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারলে সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যদি সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করতে পারি। ’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতায় ‘সোনার বাংলা’ বলতে পাকা ধানের সোনালি রংকে বুঝিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে ‘কমপ্লিট বাংলাদেশ’কে বুঝিয়েছেন। তিনি সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন পরিপূর্ণ বাংলাদেশ চেয়েছেন। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি, তা এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, গত ৪৫ বছরের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তার আংশিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। তবে এ সফলতা আরো দ্রুততর সময়ে ভালোভাবে হতে পারত। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েই গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আমাদের দিতে হবে। এসব দুর্বলতা সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনে, মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়। আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এটি অর্থনৈতিকভাবে একটি দেশকে অনেক পিছিয়ে দেয়। ‘সোনার বাংলা’ মানে উন্নত বাংলাদেশ। এটি পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি রোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তা ছাড়া উন্নত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো দেশের বিপুল শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলা, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি সামান্য।