স্বাধীনতার অঙ্গীকার
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী: বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস, মুক্তিযুদ্ধের মাস, মুজিবের মাস। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশন বাতিল করার পটভূমিতে অপমানিত, বঞ্চিত বাঙালির ক্ষোভ আর ক্রোধের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১-এর ১ মার্চ। এ পর্যন্ত আসতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু হওয়া যাত্রার পথে পথে অনেক বন্ধুরতা ছিল। কিন্তু সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই স্বাধীনতা। ২১ ফেব্রুয়ারি ’৫২, চুয়ান্ন’র নির্বাচন, আইয়ুবীয় সামরিক অপশাসনের আটান্ন, বাষট্টির ছাত্র-আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা ও স্বায়ত্তশাসনের মহান আন্দোলন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আষট্টিতে এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। সত্তরের নির্বাচন, জলোচ্ছ্বাস, ’৭১-এর সশস্ত্রতা। এই হচ্ছে স্বাধীনতার পথে বাঙালির অভিযাত্রা। ইতিহাসের এই অভিযাত্রার প্রত্যেক স্তরে স্তরে মুজিব নেতৃত্বের উপস্থিতি এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগে বাংলার একক মুখপত্র ও শেষভাগে একচ্ছত্র অধিনায়ক।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথে আমাদের এসব ঘটনা যে পরিচালিত করেছে তা সকলেরই জানা। ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২ মার্চ আমরা ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একত্রিত হই ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে। আ স ম রবের সভাপতিত্বে সেই সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা নির্ধারণ করা হয় এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৩ মার্চ পল্টনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এই সভায় তদানীন্তন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। তারপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু তার এই অভিভাষণে যুদ্ধে তার অনুপস্থিত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই বলেÑ ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…।’ এই ভাষণেই তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
তিনি যেন ঘোষণা করলেন কবি নজরুল থেকে সেই অমর বাণীÑ ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।’ অতঃপর ২৩ মার্চ। সমগ্র বাংলায় সেনানিবাস ছাড়া সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা। সারাদেশ এক ইস্পাত দৃঢ় ঐক্যে পথ চলছে স্বাধীনতার লক্ষ্যে। ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি শাসকচক্রের চক্রান্ত অব্যাহত বাংলাকে চির পদানত করার লক্ষ্যে। চলছে সৈন্য সমাবেশ। সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস। চূড়ান্ত পর্যায়ে ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ক্র্যাক ডাউন এবং ২৬ মার্চ প্রত্যুষে মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা।
২৬ মার্চ পৌঁছতে বাঙালি যে পথ পরিক্রমা করেছে সেসব ঘটনাবলি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এবং সমস্ত ঘটনাবলির কেন্দ্র ছিলেন রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সারা মার্চজুড়ে অগণিত ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সময় অসহযোগ চলতে থাকাকালে আন্দোলনকে একটি সুনির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালনা করতে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের একটি প্যারালাল সরকার গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ নির্দেশাবলি জারি করতে থাকেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর হয়ে তাজউদ্দিন সর্বমোট ৩৫টি নির্দেশ জারি করেছিলেন। এতে একটি প্যারালাল সরকার দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ (নির্বাচনী রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে) স্বাধীনতা ঘোষণার নৈতিক ও আইনগত অধিকার অর্জন করেছিলেন। আর এভাবেই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র বৈধ কর্তৃত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছিল। এবং তিনি জনগণ অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। আমাদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এ তা এভাবে বিধৃত হয়েছেÑ ‘এবং যেহেতু এরূপ প্রতারণাপূর্ণ ব্যবহারের বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখ-তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’ অতঃপর এই ঘোষণার অনুবৃত্তিক্রমে ঘোষণা করা হয় ‘এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখ-ের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে।
সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণ-পরিষদ গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ।
সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম, এবং….।’
আইনসংগতভাবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণে এটিই সত্য কথা। কেউ যদি ভিন্ন কিছু বলতে চান তা হলে তা হবে আইনের দৃষ্টিতে অচল ও অসাংবিধানিক বক্তব্য। যদিও ইতিহাস শুধু আইন বা সংবিধান মেনে এগোয় না। ইতিহাসের নিজস্ব গতিময়তা আছে, যা আইন বা সংবিধানের চেয়েও শক্তিশালী। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
মোদ্দাকথা, ২৬ মার্চ অকস্মাৎ কোনো দিবস বা ঘটনা নয়। ২৬ মার্চ হচ্ছে বাঙালির সযতনে লালিত স্বাধীনতা আকাক্সক্ষার বাঙ্ময় রূপ। ২৬ মার্চকে আলাদা করে বা ইতিহাসের ধারাবাহিকতার বাইরে রেখে বিবেচনা করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা এতে সমূহ বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে, ’৪৭-’৭১ পর্যন্ত এক ধারাবাহিক রাজনীতির ফসল, যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজনীতিকরা আর কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাও অস্বীকার করা হয়। রাজনীতির বিপরীতে সমরতান্ত্রিকতাকে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি দর্শনের আলোকে বাংলাদেশকে সাজাবার অপপ্রয়াস থেকেই উটকো বিতর্ক দাঁড় করিয়ে বিভ্রান্তির জাল বোনা হয়। সুতরাং, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসকে আমাদের ইতিহাসের পরম্পরার আলোকে দেখতে হবে।
০২
স্বাধীনতার পথ আমাদের জন্য কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না এবং এখনও না। চারদিকে ’৭১-এর পরাজিত হায়েনারা ওতপেতে আছে। সময় সুযোগ পেলে নানা আবরণে নানা নামে বাংলাদেশকে দুর্বল করার প্রক্রিয়ায় লিপ্ত। অবশ্য এসব কুলাঙ্গাররা স্বাধীনতার পরপরই এই মিশনের পরিকল্পনা করে কাজে নেমে পড়ে। যে গণতান্ত্রিকতার বিজয়গাঁথা গাইতে আমরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলাম রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর কালরাত্রির নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে সেই বিজয়গাঁথা নস্যাতের প্রয়াস আমাদের পথ চলতে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে এবং সেই থেকে শুরু। অথচ অগণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসন শুধু গণতন্ত্রকেই বিপথগামী করতে সচেষ্ট নয়, স্বদেশকে অগ্রযাত্রার বিপরীতে নিয়ে যেতেও সচেষ্ট ছিল। জাতি বারবার হোঁচট খেয়েছে এবং বারবার উঠে দাঁড়িয়ে পথ চলেছে। সর্বশেষ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, ডিসেম্বর ২০১১ ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১২-তেও অন্ধকারের সরীসৃপেরা গণতন্ত্রকে ছোবলে ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত করার ব্যর্থ প্রয়াস পেয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব জাতিকে স্বৈরতান্ত্রিকতার পথ থেকে রক্ষা করেছে। আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনী তার নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছে। আর এসব পথপরিক্রমা পেরিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। বাংলার জনগণ ’৭১-এ যেমন দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল এখনও নেতৃত্বে সংগ্রাম অব্যাহত।
তাই সব কিছু মিলিয়ে এবারের স্বাধীনতা দিবস আমাদের জন্য খুবই গুরুত্ববহ। বিশেষ করে গণতন্ত্র নস্যাৎ করার চক্রান্ত সম্পর্কে গণতন্ত্রকামী সকল মহলকে সতর্ক থাকতে হবে। গণতন্ত্র শুধু শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র পন্থাই নয়। গণতন্ত্র একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ এবং অব্যাহত অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ হতে দেওয়া যায় না। গণতন্ত্রের পরে সকল শক্তিকে ইতিহাসের পাঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলতে হবে। এবারের স্বাধীনতা দিবসের এটাই আহ্বান। জয়তু স্বাধীনতা। জয়তু বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাঠ কিংবা শিক্ষাগ্রহণ আরও জরুরি। কারণ বাংলাদেশ এখন যে পথে হাঁটছে কিংবা লড়াই করছে এটাই তার গন্তব্য। আমরা অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে ইস্পিত সফলতা দেখিয়েছি, তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়! পদ্মা সেতুর নিজস্ব অর্থায়নই আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর এই চলমানধারা অব্যাহত রাখতে পারলে আমরা এক উন্নত বাংলাদেশের পথে অগ্রসর হতে পারবÑ এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। জয় বাংলা।