স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু
মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা, আত্মমর্যাদাবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং শৃংখল মুক্ত হবার আকাক্সক্ষাই জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের। আর মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজন ছিল সুসংহত রাজনৈতিক সংগঠনের এবং দৃঢ়প্রত্যয়শীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপযোগী রাজনৈতিক নেতৃত্বের। ১৯৭১ এ ভয়াবহ যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যই প্রমান করে একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপস্থিতি, যার নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঙালী জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির স্বাধীনতার ফেরিওয়ালা, ঘোষক, তিঁনিই আমাদের মুক্তিদাতা। দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় আমরা পরাধীনতার শিকল ছিড়েছি তাঁরই নেতৃত্বে, তাঁরই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধে। আজও কানে বাজে বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান রক্তে আলোড়ন তোলে- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বাংলাদেশের স¦াধীনতার মূলভিত্তি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ, যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। বাংলা ভাষাভিত্তিক আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস হাজার বছরের ।
১৯৪৮ সাল হতে ১৯৫২ পর্যন্ত পরিচালিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গনআন্দোলন, ১৯৭০ এর সংসদ নির্বাচন, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এই সবই ছিল মওলানা ভাসানি, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দেলনের ফল। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর আপতদৃষ্টিতে বাঙালী জাতিসত্ত্বা তথা রাষ্ট্রসত্তা গঠনের সম্ভবনার পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বাঙালী জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য, বেদনা ও সংগ্রামকে অঙ্গীকার করে সেই অবরুদ্ধ, অসম্ভবের ভূখন্ডে নতুন করে শুরু হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সমগ্র জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম ও প্রত্যাশার কেন্দ্রীয় পুরুষে পরিণত হয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাঙালীর প্রথম রাষ্ট্রসত্বার স্থপতি।
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে, ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যকেও বিকৃত করার এক ঘৃন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরা যারা এই বাংলাদেশের জন্মকেই স্বীকার করতে পারে নাই।
বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক আর সে কারণেই পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক তথা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলখানায় নয় মাস বন্দী করে রাখে এবং তাঁর বিচার ও ফাঁসির আয়োজন ও করেছিল। যারা দাবি করেন যে, মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক তাদের সশ্রদ্ধ মনে করিয়ে দিতে চাই যে, পাকিস্তান সরকারও কখনো জিয়াউর রহমানকে বাঙালীর স্বাধীনতার ঘোষক আখ্যা দেন নাই বা তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবেও চিহ্নিত করেন নাই। পাকিস্তান নামক সেই রাষ্ট্র যেহেতু জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষনা করেনি বা বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করায়নি তাহলে তিঁনি কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হলেন? ব্যাপারটি বোধগম্য নয়।
বঙ্গবন্ধুর বজ্র কন্ঠে ঘোষিত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখেই এদেশের কোটি কোটি মানুষ শুনতে পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান। বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করলেন, “ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ……. রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”
বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটের ঘোষনাটিই ছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষনা, তিঁনি বলেন এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগন, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষনিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সারা দেশে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাস ভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। আর তার তিন দিন পরে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের জন্য বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। উল্লেখ্য যে, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মত মুক্তিযুদ্ধে নাম দিয়ে ছিলেন। আর তাই বলছি জিয়াউর রহমানকে যারা স্বাধীনতার ঘোষক আখ্যা দেবার জন্য মরিয়া হয়েছেন ইতিহাস বিকৃতির ঘৃণ্য খেলায় তাদের ঠাই হবে ইতিহাসের এক ঘৃণিত অধ্যায়ে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়ানো এক স্বাধীন জাতি। বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উপহার বাংলার স্বাধীনতা। অবিভক্ত বাংলা, পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের দর্শনের প্রান পুরুষ, পিতা একমাত্র তিঁনি । বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা ও প্রবর্তক। পাকিস্তানী বাঙালীদের স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালীতে রূপান্তরিত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও বাঙালিদের বাঙালিত্বের যে সুপ্ত অনুভূতি ছিল, বঙ্গবন্ধুই সেই অনুভূতিকে বাস্তব জাতীয়তাবাদের চেতনায় রূপান্তরিত করেন এবং সেই চেতনা সমৃদ্ধ হওয়ার কারনেই স্বাধীকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালীরা স্বাধীন হতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি পরিপূরক শব্দ। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একটি জাতি হিসেবে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার এ অঞ্চলে বাংলাদেশের যে অভ্যূদয় তাঁর কৃর্তি পুরুষ বঙ্গবন্ধু। বাঙালী জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান কত বড়, কতটা অপরিহার্য ছিলেন তিঁনি আিমাদের জন্য, তার প্রমাণ পাই – যখন তাঁর প্রেরনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভেতর দিয়ে উজ্জ¦ল ও উদ্ভাসিত হয়েছিল এ জাতি, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তে অসাম্প্রদায়িক, উদার, মানবিক ও গনতান্ত্রিক চেতনায়।বাঙালী জাতির হৃদয়ে যে অগ্নিশিখা আছে তাদের উদ্দীপ্ত ও উদ্ভাসিত করা যে সম্ভব, এই সত্য বঙ্গবন্ধু উদঘাটন করেছিলেন। বাঙালী জাতির হৃদয়ে সুপ্ত সেই দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদাবোধের আগুন তিনি প্রজ্বলিত করেছিলেন আপন হৃদয়ের উত্তাপ ও উজ্জ্বলতা দিয়ে।
আর সে কারনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, পরাধীন মানুষের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নাম স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও কায়েমী স্বার্থের শৃংখল ছিন্ন করে মানুষের অধিকার তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, যার জীবনের পরমব্রত ছিল বাঙালীর স্বাধীনতা। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের ¯্রষ্টা তিঁনি। চরমত্যাগ তিতিক্ষা লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছি। যার পুরোধা-প্রাণপুরুষ এক জনই আমাদের বঙ্গবন্ধু।
শেখ মুজিব স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, এর রূপকার ও প্রকৌশলী। তাঁর নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে বাঙালীর স্বাধীনতা। জাতীয়তা বোধের জাগরনে, অন্যায়ের শোষনের প্রতিরোধে, অধিকার অর্জনের সংগ্রামে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার ও দেশকে ভালোবাসার প্রেরনা জোগাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ হয়ে রইবে আমাদের দিশারী- কান্ডারী ।
বাঙালী একটি জাতিতে পরিনত হয়েছে বস্তুত পূর্ব বঙ্গকে ঘিরেই এবং তা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে। এই দেশকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন করেছিলেন। তাঁর আজন্ম স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলার। বঙ্গবন্ধুর রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার সেই রক্তঋণ আমরা শোধ করতে পারিনি। আসুন সকলেই সকল বির্তকের উর্দ্ধে উঠে বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য তার অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ন করার লক্ষ্যে হাত হাত রেখে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দৃপ্ত শপথ গ্রহন করি। -এই হোক আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার।