বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামমুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

স্বাধীনতার রক্ত ঝরা দিন গুলোতে একুশের গান ও এক জন গনসংগীত শিল্পীর ডায়েরী ২য় পর্ব।

আজ আবার হাফিজ ভাইয়ের ডায়রীটা নিয়ে বসলাম।মাঝা মাঝি এক জায়গায় এসে চোখটা আটকে গেলো। এখানে উনি লিখেছেন তার আরেকজন খুবই ঘনিস্ঠ জনের কথা, নাম নিজামুল হক, ভাষা সৈনিক গাজী উল হকের ছোটো ভাই।

“নিজাম ভাইয়ের কথা মনে হলেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। উনিও মারা গিয়েছেন। আমরা তার জন্যও কিছু করতে পারিনি। অথচ এই মানুষটিই আমাকে সহ ফকির আলমগীর, জাহাংগীর, খসরু, মুর্শেদ, রুলিয়া এবং আরও অনেককেই টেনে এনেছিল গন সংগীতের জগতে।
প্রতিস্ঠা করেছিলেন গনশিল্পী গোস্ঠীর।

সত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারীর ফাংশনের প্রস্ততি চলছিল আমাদের পাড়ার একটি বাসার বারান্দায়। রিহার্সালে আলমাস ভাই আমাদের নিয়ে একটি জনপ্রিয় কোরাস গানের রিহার্সেল করাচ্ছিলেন ‘ঘুমের দেশে ঘুম পাড়াতে ঘুমিয়ে গেল যারা। জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে ভোরের করুন তারা’ …

মনে পড়ে এমনি সময় নিজাম ভাই এসে আমাদের পাশে বসলেন। আমরা কেউই তাকে চিনতাম না।উনি মনযোগ দিয়ে আমাদের গানগুলো শুনলেন। তারপর হারমোনিয়াম টা ধরে বল্লেন ‘গাও তো আমার সাথে’।
গানটি কি ছিল তা এখন আর মনে নেই।
পরে জানলাম নিজাম ভাই আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন। তিনি আমাদের রিহার্সেলের কথা জানতে পেরে নিজ থেকেই সেখানে এসেছিলেন ।মানুষটি ছিলেন ছোটোখাটো ,মোটামুটি ফর্সা গোলগাল চেহারা সাথে একটা মানানসই গোঁফ। দেখতে অনেকটা গাজীউল হকের মতই।
এর পর থেকে উনি প্রতিদিন আমাদের রিহার্সেলে যোগ দিলেন এবং কতগুলো অবিস্মরণীয় গান শেখালেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল :

১। ‘জাগ জাগ জাগরে কৃষান শ্রমিক ভাই জাগরে। মজলুম জনতা আজ জাগরে…’

২।’নোঙর ছাড়িয়া নায়ের দে দুখি নাইয়া , বাদাম উড়াইয়া নায়ের দে’।

৩। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, গুড়ু গুড়ু ডম্বুরু পিনাকী বেজেছে বেজেছে , মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরনী ভাসানো ঢেউ উঠছে’।

৪. দিন এসেছে এইবার, কৃষান তোমার ভয় কি আর ! শ্রমিক তোমার ভয় কি আর, শক্ত হাতের বজ্রমুঠোয় ধর হাতুড়ি কাস্তে আর, মার শাবল, হেইয়া হেই মার শাবল ….

(৫) ‘প্রানে প্রানে মিলে করে দাও তুফানের ঘুর্ণি ঘুড়াও জীবনের ঝরা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব কাপাও। আমাদের একটি জীবন যেথায় নিধন করবি তোরা , সেখানে লক্ষ হয়ে জন্ম লয়ে জাগবো মোরা ‘…. ।

এ গানগুলো আমরা একুশের ফাংশনে গেয়েছিলাম। সেখানে উনি একক কয়েকটি গান গেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলো, ‘ টমটম ওয়ালা আমি ভাই, সকাল সন্ধ্যা গাড়ি চালাই, টমটম ওয়ালা…টক্‌ টক্‌ ‘ 
মুখ দিয়ে তিনি টক টক আওয়াজ টা যে কিভাবে করতেন আশ্চর্য! মনে হতো সেখানেই টমটম চলছে। ওনার গাওয়া আরেকটি অবিস্মরণীয় একক গান

‘ওঠো দুনিয়ার গরীব ভুখারি জাগিয়ে দাও
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।
কৃষান শ্রমিক পায়না যে মাঠে শ্রমের ফল ,
সে মাটির প্রতি শষ্য কনায় আগুন লাগিয়ে দাও…

সত্তরের সেই একুশে ফেব্রুয়ারীর ফাংশনেই জন্ম হলো গনশিল্পী গোষ্ঠীর পল্লীমা সংসদের একটি অঙ্গ সংগঠন হিসেবে।স্বাধীনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে।গনশিল্পী গোষ্ঠি ছিল তার মধ্যে একটি স্ফুলিঙ্গের মত। গলায় গামছার মধ্যে হারমোনিয়াম বেধে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পথের মোড়ে মোড়ে ইটের পাঁজায় দাড়িয়ে পথসভায় নিজাম ভাই এর শেখানো গানগুলো আমরা গাইতাম । সেই গান গুলো স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় গনজাগরনে যুগিয়েছিল এক বিরাট অনুপ্রেরনা।

নিজাম ভাইয়ের নেত্বৃত্বে আমরা ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলা শহরে এ গান গুলো পরিবেশন করেছি।সে সময় একবার খুলনার এক শ্রমিক সংঘঠনের আমন্ত্রনে তাদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমরা ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম।।তারুন্যের আবেগে এতই উচ্ছসিত ছিলাম যে ট্রেনে আমরা সারাক্ষনই গান গাইছিলাম।যখন স্টেজে উঠলাম তখন আমাদের কারো গলায় কোনো আওয়াজ নেই।সে যাত্রা নিজাম ভাই একাই দশ বারোটা গান গেয়ে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন।

আমরা কেউ শিক্ষিত গায়ক ছিলাম না বা চর্চাও করতাম না , তাই হয়তো শ্লোগান মুখর, বলিস্ঠ শব্দে সে গান গুলো গাইতে আমাদের কষ্ট হতোনা। অনেক সময় মাইক ছাড়াই আমাদের গান গুলো গাইতে পারতাম।

সে সময় আরেকটি বিখ্যাত গন সংগীতের দল ছিল উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী। দেখা যেত অনেক সময় আমরা একই ফাংশনে দু দলই উপস্থিত। অজিত রায়ের নেতৃত্বে উদিচীর গন সংগীত গুলো ছিল অনেক নরম টাইপের হারমোনাইজড।কিন্ত খোলা মাঠের ফাংশনে জনতা আমাদের গান গুলো ই মনে হয় বেশী পছন্দ করতো। কারন আমাদের গান গুলো ছিল শ্লোগানধর্মী যাতে শ্রোতা জনতা সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে যেত। একবার তো জিনজিরায় এক ফাংশন শেষে আমাদের শ্রোতারা আমাদের টাকার মালাই পরিয়ে দিয়েছিল।

সে সময় আরেকটি ঘটনা, দিন ক্ষন মনে নেই নিজাম ভাই সবাইকে সাদা পান্জাবী পরে তার বাসায় যেতে বল্লো। যথারীতি আমরা হাজির হোলাম।তিনি আমাদের সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন এফডিসিতে।
সেখানে বিখ্যাত পরিচালক জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবির স্যুটিং চলছিল।অভিনেতা আনোয়ার হোসেন ‘দাও, দাও, দাও, দুনিয়ার যত গরীবকে আজ জাগিয়ে দাও’ গানটি র শ্যুটিং এর প্রস্ততি নিচ্ছিলেন।জহির রায়হান শ্যুটিং এ আনোয়ার হোসেনের পেছনে আমাদের দাড় করিয়ে দিলেন। কিন্ত মজার বিষয় হলো পর্দায় যখন আমরা সিনেমাটি দেখলাম তখন আমাদের দশ পনেরো জন গায়কের মধ্যে মাত্র দুজনকে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম।

নিজাম ভাইয়ের সংগৃহীত সব গান গুলোই ছিল ভারতীয় গন নাট্য সংস্থা যা কিনা আই পি টি এ নামে পরিচিত ছিল। অধিকাংশ গান গুলোই ছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস , সলিল চৌধুরী এবং আরো অনেক বিখ্যাত সব গন সঙ্গীত রচয়িতার লেখা ও সুর করা। দুঃখ লাগে যে আমাদের কন্ঠে গাওয়া সেই গান গুলো আমরা সংরক্ষন করে রাখতে পারিনি। আরো একজন ছিলেন তার গানও সংরক্ষন করতে পারিনি তিনি হলেন সাধন ঘোষ। অত্যন্ত বলিস্ঠ কন্ঠ যেনো গন সঙ্গীতের জন্যই তৈরী।তার লেখা ও সুর করা দুটি গান মনে পড়ে। গানদুটো ছিল ‘ বাংলার কমরেড বন্ধু এইবার তুলে নাও হাতিয়ার । ভুমিহীন কৃষক আর মজদুর গন যুদ্ধের ডাক এসেছে’, আরেকটা ছিল ‘স্বাধীন দেশে জন্ম তবু স্বাধীন তারা নয়, তাইতো দেখি প্রতি দিনই শহীদ দিবস হয়’।

স্বাধীনতা পুর্বকালে নিজাম ভাইকে নিয়ে সবচেয়ে সাহসী ঘটনাটি ছিল ডিআইটি টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে গন শিল্পী গোষ্ঠীর গন সংগীতের সরাসরি সম্প্রচার।এটা সংঘটিত হয় দুঃসাহসী প্রযোজক পরবর্তী তে যিনি বিটিভির পরিচালক হয়েছিলেন মোঃ মুস্তাফিজুর রহমানের প্রযোজনায়। কারন সময়টা ছিল উনিশ ও একাত্তরের ফেব্রুয়ারী বা মার্চের কোনো এক সময়, তারিখ টা মনে নেই। একই সময় টিভিতে শেখ লুৎফর রহমানের নেত্বৃত্বে সেই বিখ্যাত গান ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে’ গানটির শ্যুটিং হচ্ছিল সেটাতেও আমরা অংশগ্রহন করেছিলাম। অকুতোভয়ী প্রযোজক মুস্তাফিজ ভাই (আমাদের পড়শী ) কে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান টিভি কর্তৃপক্ষের রোষানলেও পরতে হয়েছিল।

গন শিল্পীর আমরা শুধু গান গেয়েই ক্ষান্ত ছিলাম না।স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই ক্রান্তি লগ্নে নিজাম ভাইয়ের বাসায় বসে সিদ্ধান্ত হলো রড দিয়ে বল্লম বানিয়ে মহল্লায় পাহারা দেয়ার। দলবেধে বল্লম নিয়ে রাতে পাহারা শুরু হলো।এখন ভাবলে অবাক লাগে কি আন্ডারএস্টিমেট ই না করেছিলাম পাকিস্তানী হানাদার বাহীনিকে।২৫ মার্চ রাতে আমার ডিউটি ছিলো না।রাত বারোটার দিকে গোলাগুলির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।তার পর শুরু হলো আরেক অধ্যায়”।

আজ এখানেই শেষ করলাম, উনি যে ভাবে লিখেছেন আমি সে ভাবেই লিখে যাচ্ছি এলোমেলো ভাবে।
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *