ইতিহাস : প্রবন্ধ

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান

ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বীরবিক্রম: মেহেরপুর পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী মহকুমা। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় কৃষ্ণনগর থেকে কেটে এই ছোট মহকুমাটির সৃষ্টি হয়। ভারত বিভাগের মূল নকশার স্যার র‌্যাডকিফের অপরিণামদর্শী আচরণ ও নানান খামখেয়ালিপনার এটি একটি উদাহরণ। কারণ মেহেরপুর ও কৃষ্ণনগরের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক সীমারেখা নেই। এই বৈশিষ্ট্যটি কয়েক যুগ পরে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে মেহেরপুরের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হবে, সে কথায় পরে আসছি।
পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের এই সীমান্তবর্তী ভূখ-ও ২৪ বছর পর ইতিহাসের ¯্রােতধারায় একাকার হয়ে গেল।
মেহেরপুর পলাশী যুদ্ধপ্রান্তর হতে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে যেখানে ১৭৫৭ সালে সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের সূচনা হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে পলাশীর যুদ্ধ মানব ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ এবং পশ্চিমা সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ঘটনা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ পরিত্যাগের সময় হাজার মাইল দূরের দুটি ভূখ-কে এক দেশ বা পাকিস্তান হিসেবে জন্ম দিয়ে একটি অবাস্তব রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে যায়।
১৯৭১-এর মার্চ মাসকে তাই ইতিহাসের শুদ্ধি অভিযানের সময় বললেও অত্যুক্তি হবে না।
পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের তিন দশকের শঠতা, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুকৌশলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের অহিংস আন্দোলনে সারাদেশ যখন উত্তাল, মেহেরপুরও তখন এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে ছোট্ট নিভৃত এই সীমান্ত এলাকার মহকুমা প্রশাসক ছিলাম আমি।

মুক্তাঞ্চল ঘোষণা
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া, যশোর (শুধু সেনাছাউনিকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সিলমোহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দেই ৫০০ টাকার ওপর কাউকে পরিশোধ না করতে। এমনকি ভারতের সাথে আমাদের এই বোঝাপড়া হয় যে, আমরা সরকারি সিলমোহর এবং দস্তখত করা সার্টিফিকেট মোটামুটি পাসপোর্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি মেহেরপুরের প্রশাসনের ভার মেহেরপুরের সেকেন্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা গ্রহণ করি।
এই সময়ে প্রতিদিন অনেক বিদেশি সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমাদের মুক্তাঞ্চল ঘুরে-ফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকূল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করছিলাম তা নয়, এ রকম একটা সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। আমাদের এই সামরিক বিজয়, জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প তাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল।
তাদের সবারই একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়? আমরা উত্তরে জানাই যে, অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমরা ভারতের টুঙ্গী বিওপিতে তাজউদ্দিন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎও করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির বিষদ পর্যালোচনা করি। তারা আশ্বাস দেন যে, অতি শীঘ্রই সরকার ঘোষণা করা হবে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিক থেকে যুদ্ধ একটি নতুন মোড় নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশোর সেনানিবাসে নতুনভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমার অভিমত এই যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি বাঙালিরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার পরাজয়ের গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রি-ইনফোর্সমেন্ট ঢাকা থেকে যশোর আনা শুরু হয়। আমরাও রুদ্ধশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। এক এক সময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশোর সেনানিবাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশোর সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে, হয়তো যশোর আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লোকের প্রাণের বিনিময়ে। এত বড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
এই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় বিশাখালীতে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহের ওপর প্রচ- আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মোকাবিলা করে। হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষাব্যূহ পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। এই প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোবলের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আমরা উপলব্ধি করি যে শত্রুর দূরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেওয়ার মতো অস্ত্র আমাদের নেই। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদের পিনডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারি কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের ওপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমণের সাথে আমাদের মনোবলও ভেঙে যাচ্ছিল এবং আমরা ভবিষ্যৎ বিজয়ের কোনো সামরিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমাদের অন্যান্য ঘাঁটিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না। কোনো রণাঙ্গনে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনোবলের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই।
তদুপরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থানগুলোতে খাদ্যদ্রব্য এবং গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলোতে এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যাহত থাকে। এ ছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসারও কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। ওষুধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে গোয়ালন্দের মতো জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাবূহ্য কী রকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাক ছত্রীসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ওই ঘাঁটিকে একবার উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নগরবাড়ী ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শত্রুর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠ্ঠা খান নিজে পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অপারেশন তদারকি করেন।
চতুর্দিকে শত্রুর প্রচ- আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়ছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রু আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযোগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনোবলও ভেঙে পড়তে থাকে। চুয়াডাঙ্গা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই।
যশোর সেনানিবাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জলিল। ২৫ মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠানো হয়েছিল। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আমি, মাহবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি। স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোনো চিঠিরই জবাব পাইনি। এর পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। একজন তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট আনোয়ার শাহাদাতবরণ করেন। প্রচুর বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছা ও ঝিকরগাছার দিকে অগ্রসর হয়।
ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাঙ্গায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিপ্তি, বিচ্ছিন্ন লোকদের একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্রযুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চুয়াডাঙ্গায় আসে। তার কাছে আমি জানতে পারি যে তারাও ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য আবেদন করছিল। এই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যৌথভাবে সামরিক পরিকল্পনার সূচনা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান
মেহেরপুরের কোনো এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। তাই আমরা তাজউদ্দিন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকি। এই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচ- আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়েরই সূচনামাত্র।
১২ এপ্রিলÑ দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোনো স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনোবল ভাঙতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনোবল অক্ষুণœ থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলো ব্যর্থতা আমাদের যোদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ কিংবা ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবে। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। ৩টি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারণের কাজ করতে হয়েছে :
১. শত্রুর অবস্থান থেকে দূরত্ব বজায় রাখা;
২. ভারতীয় এলাকা থেকে সহজ যাতায়াতের সুযোগ থাকা এবং
৩. শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রার জন্য ছদ্মাবরণ থাকা।
১৬ এপ্রিল মাহবুব ও আমি চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটজনক সময়। আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তার সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত। পাকিস্তানি বাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনও জানতাম না আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারব।

১৭ এপ্রিল
নীরব আ¤্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষ। অতীতে এখানে কোনো অনুষ্ঠান হওয়ার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্য দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখছেÑ বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক। মেহেরপুরের নীরব নিস্তব্ধ আ¤্রকানন। ভাগ্যের লিখনে আজ তা ঐতিহাসিক এক ঘটনার জন্য প্রস্তুত।
সকালেই মাহবুব ও আমি আমার জিপে করে এখানে উপস্থিত হই। কয়েক দিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার পর কিছু খাদ্যের জন্য লালায়িত ছিলাম। সীমান্ত ফাঁড়ির আনসার ও মুজাহিদরা তাদের উদ্বৃত্ত খাবার থেকে কিছু ডাল-ভাত আমাদের বেড়ে দেয়। আমরা গোগ্রাসে তা শেষ করি। ঘুরে-ফিরে সাদামাটা আয়োজনের কিছু তদারকিও করি। বেশ কয়েক দিন ধরেই মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল। গত রাতে মুষলধারায় বৃষ্টি হয়। ভারত সীমান্ত থেকে কয়েকশ গজ পূর্বে বৈদ্যনাথতলার সীমান্ত ফাঁড়ির পাশের আমবাগান। সকালের বৃষ্টি বিধৌত রৌদ্র¯œাত আমবাগানটি যেন এক মাহেন্দ্রণের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। আশপাশেও আরও অনেক আমবাগান। আমবাগানের বিস্তৃত চাঁদোয়ার নিচে পুরনো ধরিত্রী পুনরুজ্জীবিত। ফাঁকে ফাঁকে সূর্যরশ্মি সকালে খেলায় ব্যস্ত। একটা মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে নিতান্তই সাদামাটা। সামনে কয়েক সারি কাঠের চেয়ার। আশপাশের গ্রাম থেকে এবং কিছু সীমান্তের ওপারের ভারত থেকেও আনা হয়েছে। ১০-১১টার দিকে একটা গাড়ির বহরে বৈদ্যনাথতলা সরবে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভারত ও বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের অনেক প্রতিনিধিও সেই বহরে ছিলেন। এই নিভৃত গ্রামে আমি ও মাহবুব তাদের অভ্যর্থনা জানাই ও মঞ্চে নিয়ে যাই। অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন, বাইবেল ও গীতা থেকে পাঠ করা হয়। পাশে খ্রিস্টান মিশন থাকায় বাইবেল পাঠের লোক সহজেই পাওয়া যায়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে শোনান। সংক্ষিপ্ত এই ঘোষণায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে বাঙালির নির্যাতন, প্রবঞ্চনা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। সেই সাথে সরকারের গঠন ও দায়িত্ব সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানানো হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারের এই ঘোষণা শুনতে শুনতে আমি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে।
এরপর অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার অন্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।
স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে একটি দল জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ পরিবেশন করে। এ সময় জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানায় মাহবুবের নেতৃত্বে স্থানীয় আনসার-মুজাহিদদের ছোট্ট একটি দল। এখানে বলে রাখা দরকার, মেজর ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআর-এর একটি দলের গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা ছিল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে তারা পৌঁছতে না পারায় আমি তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করি। পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় এসব অনুষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা মাহবুবের ছিল। আমি তাকে অনুরোধ করি উপস্থিত আনসার-মুজাহিদদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়ার একটি অনুশীলন করার জন্য। মাহবুব তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হয়ে প্রস্তুতি নেয়। অত জৌলুসপূর্ণ না হলেও আনসার-মুজাহিদদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল। যদিও তাদের পোশাক-আশাক ছিল নিতান্ত সাধারণ ও মলিন। কিন্তু এই ঐতিহাসিক সুযোগের আনন্দে তারাও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। মাহবুব গার্ড অব অনার প্রদান করলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম গ্রহণ করেন এবং গার্ড পরিদর্শন করেন। মঞ্চে ফেরত আসার পর আমি উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অন্যান্য উপস্থিত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভাষণ দিলেন। শেষ ভাষণটি ছিল উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের।
দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিকসহ অন্যরা অনুষ্ঠানটি ধারণ করেন। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি দুঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল। অনুষ্ঠান শেষে সবাই আবার গাড়িতে উঠে পড়লে গাড়ির বহর যে পথে এসেছিল সেই পথে ভারতের দিকে ফিরে যায়। রূপকথার সোনার কাঠি-রূপার কাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছিল এই জনপদ। সবাই চলে যাওয়ার পর আবার সুনসান নীরবতা। ঐতিহাসিক ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকই হতবাক। ১০০ কিলোমিটার দূরে পলাশীর প্রান্তরে হৃত স্বাধীনতা ও পরবর্তী বিকৃত ইতিহাসের শুদ্ধি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। তাজউদ্দিন আহমদ তার বক্তৃতায় ঘোষণা দেনÑ এই জনপদের নাম হবে ‘মুজিবনগর’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *