হরকাতুল নেতা জঙ্গি মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর
উত্তরণ প্রতিবেদন: নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার দুই সহযোগীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ১২ এপ্রিল রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে একই মঞ্চে একই সময়ে কার্যকর করা হয় মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুলের ফাঁসি। এ ছাড়া সিলেট কারাগারে কার্যকর করা হয় আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনের ফাঁসি। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজনকে হত্যার মামলায় মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গিকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। প্রায় ১৩ বছর আগে সিলেটে ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
ফিরে দেখা
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ঘটনাস্থলেই পুলিশের এএসআই কামাল উদ্দিন নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশ কনস্টেবল রুবেল আহমেদ ও হাবিল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি মারা যান হাসপাতালে। আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ কমপক্ষে ৪০ জন ওই ঘটনায় আহত হন। পুলিশ ওইদিনই সিলেট কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সামীম মোহাম্মদ আফজাল জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদ- এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদ- হাইকোর্ট বেঞ্চ মুফতি হান্নানসহ তিন আসামির মৃত্যুদ- এবং দুজনের যাবজ্জীবন দ- বহাল রাখেন। গত ১৯ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মুফতি হান্নানের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যায়। গত ২২ মার্চ তাকে কারাগারে মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায় পড়ে শোনানো হয়। ২৩ মার্চ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যু পরোয়ানা পাঠানো হয়। কারাবিধি অনুযায়ী রিভিউ রায় পড়ে শোনানোর সর্বনি¤œ ২১ দিনের মাথায় মুফতি হান্নানের দ- কার্যকর হলো।
হুজিবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৩ বড় নাশকতা
হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজিবি) একটি ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন। ১৯৮৯ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। সে সময় ফারুকীর সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ফজলুর রহমান খলিল ও সাইফুল্লাহ আকতার নামের দুজন। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শেষ দিকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হুজিবি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান আফগানফেরত জঙ্গি শফিকুর রহমান। আফগানফেরত আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার সদস্য প্রাথমিকভাবে এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। হুজিবি কতটা নৃশংস ও বর্বর জঙ্গি সংগঠন, তা বিভিন্ন হামলার ধরন ও পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে।
কে এই মুফতি হান্নান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী কুখ্যাত জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হিরণ গ্রামে। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়াতে শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। মুফতি হান্নান ওই মামলারও আসামি। রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার দায়ে মুফতি হান্নানকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন আদালত। ওই হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানসহ আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের হাইকোর্টে করা আপিলের শুনানি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গত ৬ মার্চ একটি মামলার শুনানি শেষে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে টঙ্গীতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
মুফতি হান্নানের অপরাধনামা
২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায়ই আলোচনায় আসেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) বাংলাদেশের নেতা মুফতি হান্নান। এর পর থেকে একের পর এক জঙ্গি হামলায় তার নাম উঠে আসে।
যশোরে উদীচী হত্যাকা-
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বর্বরোচিত বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। ওই ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং আরও দুশতাধিক নারী-পুরুষ আহত হয়। ২০০৭ সালে মুফতি হান্নান গ্রেফতার হলে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তিনি আদালতে উদীচী বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।
কোটালীপাড়ায় বোমা
২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। মুফতি হান্নান ওই মামলার আসামি।
পল্টনে বোমা হামলা
২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলায় নিহত হন ৫ জন, আহত হয়েছিল অন্তত ২০ জন। আহত আরেকজন পরে চিকিৎসাধীন মারা যান। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় মুফতি হান্নান অভিযুক্ত।
রমনা বটমূলে বোমা হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার সাথে জড়িত মুফতি হান্নান। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন বিচারিক আদালতের রায়ে মুফতি হান্নানসহ আটজনের মৃত্যুদ- হয়েছে।
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হলে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরীসহ অনেকে আহত হয়। ওই হত্যাকা-ের দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলো।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ লোক আহত হয়। মুফতি হান্নান ওই মামলার আসামি। নিজের দোষ স্বীকার করে তিনি আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
কিবরিয়া হত্যাকা-
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হয়। ওই ঘটনায় মুফতি হান্নান অভিযুক্ত হয়।
বিভিন্ন সময়কালে ১৩টি বড় ধরনের এমন প্রাণঘাতী নাশকতা ঘটায় মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদ। এতে ১০৯ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০-র বেশি, যাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। ১৯৯৫ সালের পর থেকে হুজিবির নেতৃত্বে আসেন মুফতি আবদুল হান্নান। ভয়ঙ্কর জঙ্গি হান্নানই সংগঠনটির শিরোমণি হয়ে ওঠেন। যদিও ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার পর তার নাম বেশি আলোচনায় আসে। হুজিবির হামলার সব টার্গেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে তারাই একমাত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন, যারা ইসলামী শাসন কায়েমের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে প্রধান বাধা বলে মনে করে আসছে। তাই একাধিক দফায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের অনেক শীর্ষ নেতাকে টার্গেট করে হামলা চালায়।
হান্নান পর্বের সমাপ্তি
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর হুজিবির অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার হন। এর মধ্যে হুজিবির কারাবন্দি নেতা মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে আবু জাফর কিছু অনুসারী নিয়ে নতুন সংগঠন গঠনের চেষ্টা করেন। হুজিবির আরেকটি অংশ নব্য জেএমবি ও এবিটির সাথে যুক্ত হয়। সর্বশেষ গত ৬ মার্চ টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনে হুজিবি ও এবিটির জঙ্গিরা অংশ নেয়।