বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামমুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

হালুয়াঘাটের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ‘সীমান্তবন্ধু’ কুদরত উল্লাহ মন্ডল

এক মহান নেতার কথা বলছি, বলছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক অকুতোভয় সৈনিক কুদরত উল্লাহ মন্ডলের কথা, বলছি তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। হালুয়াঘাট সদরের মোজাখালি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ভূ-স্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ১০ জানুয়ারি। পিতার নাম ছমির উদ্দিন মন্ডল ও মাতার নাম কদরজান বিবি।

পিতৃহারা হন মাত্র ৮ বছর বয়সে। বিশাল ভূ-সম্পত্তির দেখাশুনা করতে গিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন খুব। বই-পুস্তক, পত্রিকা পড়ে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। পারিবারিকভাবেই তিনি ছিলেন সংস্কৃতমনা, গান-বাজনার প্রতি ছিল বেশ দুর্বলতা। তাঁর প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাংলার মেহনতি মানুষের কথা ভাবতেন। স্বাধীনচেতা কুদরত উল্লাহ মন্ডল ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে তাঁর প্রধান কর্তব্য মনে করতেন।

১৯৬৬ সালের ৮ মে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হলে ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতির নেতৃত্বের হাল ধরেন কুদরত উল্লাহ মন্ডল এবং ছাত্র-জনতাকে একত্রিত করে সারাদেশের আন্দোলনকে আরোও বেগবান করেন। ১৯৬৯ সালে পদত্যাগে বাধ্য হয় আইয়ুব খান, মামলা প্রত্যাহার হলে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মুক্ত হন।

১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু কুদরত উল্লাহ মন্ডলকে আওয়ামীলীগের পক্ষে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং তিনি বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭১ সাল। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু, ডাকে সাড়া দিয়ে হালুয়াঘাটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যান কুদরত উল্লাহ মন্ডল। ২৫ মার্চ কালোরাতের পর বঙ্গবন্ধুর আহবানে কুদরত উল্লাহ মন্ডলের নেতৃত্বেই ই.পি.আর. ক্যাম্পের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ এবং মেঘালয় রাজ্যে গিয়ে সাবেক ই.পি.আর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবকদের সংগঠিত করে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিন্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে নিরস্ত্র বাঙালি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে, ভারত সরকার আশ্রয়ের ঘোষণা দেয়। হালুয়াঘাট সীমান্তে মানুষের ঢল ক্রমশ বাড়তে থাকলে কুদরত উল্লাহ মন্ডল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গাছুয়াপাড়ায় ‘ইয়্যুথ ক্যাম্প’ স্থাপন করেন এবং আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে ক্যাম্প পরিচালনা করেন।

ইতিমধ্যেই মুজিবনগর সরকারের মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, জনাব হুমায়ুন খালিদ, সৈয়দ সুলতান, মোশাররফ হোসেন’সহ অনেক এম.পি.এ এবং এম.এন.এ কুদরত উল্লাহ মন্ডলের বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ করেন এবং মন্ডল সাহেব তাঁদেরকে নিরাপদে মিত্র রাষ্ট্র ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই পথে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর, ব্যবস্থাও করেছিলেন কুদরত উল্লাহ মন্ডল। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল। আলবদর রাজাকারেরা কুদরত উল্লাহ মন্ডলের বাড়ি পুড়িয়ে দিলে উনার পরিবারের সদস্যদের গাছুয়াপাড়া ইয়্যুথ ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায়। ভারতের সেনাপ্রধান স্যাম মানেক’শ সন্ধ্যা ৬টার দিকে জে.এফ.আর জ্যাকবকে ফোন করে বলেন, তিনি যেন ইন্দিরা গান্ধীকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এই খবরটি জানান। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন এ খবরটিও জানাতে বলেন স্যাম। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সান্থ সিং বাবাজির অনুরোধে গাছুয়াপাড়ায় সমবেত মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে আবেগঘন জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন কুদরত উল্লাহ মন্ডল। এই ভাষণে সাড়া দিয়ে সমবেত যৌথবাহিনী ‘জয় বাংলা, জয় হিন্দ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে হালুয়াঘাট সীমান্তে প্রবেশ করে। হালুয়াঘাট মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে দেশ গড়ার আহবান জানান। সে আহবানে সাড়া দিয়ে প্রথমেই কুদরত উল্লাহ মন্ডল যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ করেন এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠা করেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তৎকালীন একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হালুয়াঘাট শহীদ স্মৃতি কলেজ’ এবং ‘হালুয়াঘাট সাধারণ পাঠাগার’। কৃষি উন্নয়নের জন্য স্থাপন করেন অনেক গভীর নলকূপ।

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। গণ-মানুষের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও মহানুভবতার জন্য ভুষিত হয়েছেন ‘সীমান্তবন্ধু’ উপাধিতে। তিনি দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও হালুয়াঘাট থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ইতিহাসের কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার খবরে আর্তনাদ করে উঠেন সীমান্তবন্ধু, কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁর পরিবারের সবাই। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যার প্রতিবাদে সংগ্রামী জনতাকে নিয়ে রাজপথে মিছিল করেন তিনি এবং উপস্থিত সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে ঢাকা থেকে নির্দেশনার অপেক্ষা করতে থাকেন।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খুনি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য চেয়েছিলেন সীমান্তবন্ধুর কাছে, সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছিলেন তিনি। সীমান্তবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা-ছাত্র-যুবকদের বাঘা সিদ্দিকীর সাথে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও শীতবস্ত্র সরবরাহ করতে থাকেন। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের অভিযোগে গ্রেফতার হন সীমান্তবন্ধু এবং দীর্ঘ ৩ বছর করাভোগের পর হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি হালুয়াঘাট থানা শাখা গঠন করেন।

রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট এ সহচর, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সীমান্তবন্ধু কুদরত উল্লাহ মন্ডল ১৯৯৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *